সোনালি আঁশ যেন কৃষকের গলার ফাঁস
নীলফামারী সদরের পলাশবাড়ি খলিশা পচা এলাকার বাসিন্দা যোগেশ চন্দ্র রায়। ধান, পাট, আদা, হলুদ ও ভুট্টাসহ সবজি চাষ করেন তিনি। নিজের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেই চলে তার সংসার। গত বছর পাটের দাম ভালো থাকায় এবার চার বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেন তিনি। এর মধ্যে ২ বিঘা জমির পাট বিক্রি করেছেন ২ হাজার টাকা মণ দরে। তার দাবি গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেকে নেমেছে পাটের দাম। এ কারণে আগামী বছর থেকে পাট চাষ করবেন না তিনি।
যোগেশ চন্দ্রের মতো জেলার অনেক কৃষক পাট আবাদে বিমুখ হচ্ছেন। উৎপাদন খরচ বেশি এবং কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। কৃষকরা বলছেন, গত বছর যেখানে প্রতি মণ পাটের দাম ছিল ২৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা দরে। অপরদিকে চারা রোপণ থেকে শুরু করে আঁশ প্রস্তুতকরণ পর্যন্ত প্রতি মণ পাটে ২ হাজার থেকে ২২০০ টাকা টাকা খরচ হয়েছে তাদের।
বিজ্ঞাপন
জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব জমির পাট কাটা শেষ হয়ে গেছে। চাষীরা সেই পাট জাগ দিয়েছেন। কেউ আবার পাটের আঁশ সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধসহ সবাই একত্রে কাজ করছে। কেউ বাড়ির আঙ্গিনায়, কেউ আবার রাস্তায় পাট শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ কেউ পাট বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছেন হাটে।
পানির অভাবে সেচের মাধ্যমে পানি জমিয়ে সেখানে পাট জাগ দিচ্ছেন অনেকেই। এতে বাড়তি খরচের চাপ সইতে হচ্ছে। পাট জাগে হেরফের হলে এবং পরিষ্কার পানি না থাকলে মানসম্মত পাট পাওয়া সম্ভব হবে না। এ কারণে কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে সেচ সুবিধায় অথবা রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট জাগ দেওয়া শেষে আঁশ ছাড়ানোর কাজ করেছেন। বর্তমানে দামের হেরফের থাকলেও পাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের গুদাম নয়তো হাটমুখী হচ্ছে চাষিরা।
বিজ্ঞাপন
এদিকে সোমবার নীলফামারীর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ হাটে পাট বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ১৯০০ থেকে ২২০০ টাকা দরে। একই মানের পাট গত বছর বিক্রি হয়েছে ৩০০০ থেকে ৩২০০ টাকা দরে। সেই হিসেবে পাট চাষিরা প্রতি মণে ১ হাজার টাকা কম পাচ্ছেন। আশপাশের হাটগুলোতে একই দামে পাট বিক্রি হচ্ছে।
প্রতিদিনই নীলফামারীর কোনো না কোনো উপজেলায় পাটের হাট বসে। ভোর সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হয়ে চলে সকাল ৮টা পর্যন্ত। এসব হাটে কৃষকরা সরাসরি পাট বিক্রি করতে পারেন। কৃষকদের থেকে এসব পাট মৌসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা কিনে থাকেন। তারা পাট কিনে গুদামজাত করে রাখেন। এরপর ব্যবসায়ীদের কাছে সময় মতো তারা পাটগুলো বিক্রি করেন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সার, বীজ ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জিনিসের দামের সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকের মূল্যও। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। উৎপাদন খরচ বিবেচনায় পাট বিক্রি করে কৃষকের লাভ হচ্ছে না। ফলে হতাশ হচ্ছেন কৃষক। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সোনালি আঁশ পাট থেকে। এ ছাড়াও ভরা বর্ষা মৌসুমে খালবিলে পানি না থাকায় পাট জাগ দিতে সমস্যা হয়েছে অনেক কৃষকের।
কৃষক যোগেশ চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর ছয় বিঘা জমিতে পাট আবাদ করেছিলাম। গতবার পাটে লস করে এবার চার বিঘা জমিতে পাট আবাদ করেছি। তাতে করে এবার কিছুটা পাওয়া গেছে গতবার তাও পাওয়া যায়নি। এবার পানির কারণে পাট নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকে পাট জমিতে শুকিয়ে খড়ি করে ফেলছে। শেষের দিকের একটু বৃষ্টি হওয়ার কারণে কিছু পাট ভালোমতো নিতে পারছি। এ বছর শুরুতে পাট প্রতিমণ বিক্রি করেছি ২ হাজার টাকা দরে, মাঝে ১৮০০, এখন তো ২১০০ টাকা করে চলছে। দাম তো অনেক কম, এই দামে তো কৃষকের পোষায় না। পাট আবাদ করে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে তো পাট আবাদ করতে চাচ্ছে না কৃষকেরা।
তিনি বলেন, সরকার তো কৃষকদের দাম দেন না। কৃষকের ধানের দাম নাই, পাটের দাম নাই, তামাকের দাম নাই, অন্যান্য রবি শস্যেরও দাম নাই। সরকার তো গরিব কৃষককে মারার জন্য এগুলো করছে। কৃষক যেগুলি কিনে সেসব পণ্যের অনেক দাম। অথচ কৃষকের পণ্য বিক্রি করতে গেলে দাম পাওয়া যায় না। এভাবে চললে কৃষক বাঁচবে না। সরকারের কাছে বলার কিছু নেই। আজকে পাটের দাম যদি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ থাকতো তাহলে খরচের টাকাটা অন্তত উঠে আসতো।
ডোমারের মির্জাগঞ্জ এলাকার কৃষক মশিয়ার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সার কীটনাশকের যে দাম এর পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরির হিসেব করলে পাট চাষ করে উল্টো ক্ষতি হয়েছে। সরকার যদি দাম বাড়ায় তাহলে আগামীতে পাট আবাদ করবো তাছাড়া এভাবে ভর্তুকি দিয়ে পাটের আবাদ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।
একই এলাকার কৃষক সন্দীপ চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার পাট চাষ করে লাভ হয়নি, শুধু খরচের টাকাটা উঠে আসছে। গতবছর প্রথম দিকে পাট ২৯০০ টাকা মণ বিক্রি করেছি। এবার দাম কমে ২১০০ টাকা। যদিও সার কীটনাশকের দাম বাড়ার কারণে এবার পাটচাষে খরচ আগেরবারের চেয়ে বেশি হয়েছে।
কৃষক মমিনার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আগে গম আবাদ করেছিলাম। এরপর সেই জমিতে পাট করেছি। কিন্তু বর্তমানে যে সার কীটনাশকের দাম সে তুলনায় পাট চাষ করে বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না। সরকার যদি এদিকে একটু নজর দিত তাহলে আমরা উপকৃত হতাম। না হলে এভাবে চাষাবাদ করে ক্ষতির সম্মুখীন কেউ হতে চাইবে না।
পাট ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতবছর পাটের দাম ছিল মণ প্রতি ২৭০০ থেকে ২৮০০ টাকা। সেবার ৫০ মণ পাট কিনি। কেনার পর সেই পাট ২২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে হয়েছে। এতে আমার ৭ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। তাই এবার ২১০০ থেকে ২৩০০ টাকায় পাট কিনছি। এবার তো আশা করছি ২৮০০ টাকা করে পাট বিক্রি করতে পারবো। গতবার যেহেতু বাজার খারাপ ছিল। এবার আশা করছি পাটের দাম ভালো পাব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলা নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও লালমনিরহাটে ৫৩ হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে কৃষকরা ৫২ হাজার ২৫৪ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করেছেন। প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ২ দশমিক ৫৬ মেট্রিক টন। প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক পাট চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
অন্যদিকে নীলফামারী জেলায় এ বছর পাট চাষ হয়েছে ৬ হাজার ৬১১ হেক্টর জমিতে। তীব্র দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, রোদ এবং খরা থাকলেও বেশ কয়েকটি উপজেলায় পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার নীলফামারীতে ৯৯ হেক্টর জমিতে পাট চাষ কম হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
এদিকে উন্নত মানের বীজ সরবরাহের পাশাপাশি অনাবৃষ্টিতে পাট জাগ দেওয়ার দুশ্চিন্তা এড়াতে রিবন রেটিং এবং ভালোমানের পাট চাষ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে সরকারের কৃষি বিভাগ।
নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ডা. এস এম আবু বক্কর সাইফুল ইসলাম বলেন, পাট চাষের জন্য নীলফামারীর মাটি খুবই উপযোগী। জলবায়ু পরিবর্তনে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন। তবে আমরা সোনালি আঁশ খ্যাত এ পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ আফতাব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাট আবাদের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ কিছুটা কমে এসেছে। কারণ পাট পচানোর জায়গা নেই। এখন পুকুর-জলাশয় মাছ চাষের আওতায় এসেছে। ফলে মাছ চাষ করা পুকুর-জলাশয়ে পাট জাগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া পাট যে মৌসুমে হয় ওই মৌসুমেই অন্য ফসলে তুলনামূলকভাবে বেশি আয় করা সম্ভব হয়। অনেকে লাভের হিসাব করে পাটের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
পাটের ব্যবহার বা পাটজাত পণ্যের উৎপাদন সংকুচিত হয়ে আসছে বলে মনে করছেন এই কৃষিবিদ। তিনি বলেন, পাটের সুতা থেকে তৈরি পণ্যের আশানুরূপ ব্যবহার বাড়েনি। এখনও কৃত্রিম ও প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য এবং ব্যাগের ব্যবহার রয়েছে। সেক্ষেত্রে পাটজাত পণ্যের বাজার প্রসারিত হয়নি বলা যায়। অন্যদিকে পাট চাষ থেকে শুরু করে পাট জাগ দেওয়া, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় জটিলতা রয়েছে। কৃষকের প্রত্যাশানুযায়ী বাজারও স্থিতিশীল থাকে না। নানামুখী কারণে কৃষকরা পাট চাষ থেকে বিমুখ হচ্ছেন।
কৃষিবিদ আফতাব হোসেন আরও বলেন, আমাদের সরকারের উদ্দেশ্যই হলো কৃষককে স্বাবলম্বী করা। কৃষকের আয় বৃদ্ধি করাসহ আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা। সরকার পাটচাষিদেরও প্রণোদনা দিচ্ছেন, যাতে নতুন জাতের পাটের চাষাবাদ বাড়ে। রবি-১ পাটের নতুন জাত। এর জন্য প্রণোদনা রয়েছে। তবে প্রাকৃতিক কারণে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন বা ফসলের ক্ষতি হয় সেক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে।
এএএ