স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না জোবেদার
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার নিম্নবিত্ত এক পরিবারে জন্ম জোবেদা আক্তারের। বলা যায় জন্মের পর থেকেই শুরু হয় দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম। সমাজের কটু কথা, অর্থনৈতিক বাধা ও নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে মেধাকে পুঁজি করে ছুটে চলেছেন স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। ভালো ফলাফলের জন্য স্কুল ও কলেজে পেয়েছেন বোর্ড বৃত্তি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও অনুষদে প্রথম হওয়ায় পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকও। এখন তার স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করা।
জোবেদা আক্তারের বাবা জহুর আলী রাজমিস্ত্রি এবং মা গৃহিণী। নিজেদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সন্তানদের পড়াশোনা করার জন্য তাগিদ দিতেন। মা-বাবার উৎসাহে জোবেদা আক্তার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
বিজ্ঞাপন
জোবেদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পরিবারে যেখানে তিন বেলার খাবার জোগাড় করাই ছিল অনেক কষ্টের, সেখানে পড়াশোনা করতে চাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। কিন্তু অনেক পরিশ্রম ও কষ্ট করার পরও মা-বাবা কখনো পড়াশোনা বন্ধ করতে বলেননি। পাড়া-প্রতিবেশীরা নানা কটু কথা বললেও মুখ বুজে সহ্য করে পড়াশোনা করেছি। আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে বাবা-মা মানুষের মতো মানুষ হওয়ার উৎসাহ দিতেন। তাদের স্বপ্ন পূরণে খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা করেছি। ভালো ফলাফল করায় স্কুল ও কলেজের শিক্ষকরা অনেক সহযোগিতা করেছেন। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর বোর্ড বৃত্তি পেয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে অনেকটা পড়াশোনার খরচ এগিয়ে নিতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকে যখন আর্থিক সমস্যার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব কিনা এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম, সেসময় ইসলামী ব্যাংকের আওতায় গরিব মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদন করে বৃত্তি পাই। এরপর নিজ প্রচেষ্টায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হই। আর্থিক ও যাতায়াতের সমস্যার কারণে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ারও সুযোগ হয়নি।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টকে জোবেদা আক্তার বলেন, মা-বাবা ধারদেনা করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা দেন। এরপর সেমিস্টার ভর্তি ও ফাইনাল পরীক্ষার ফরম ফিলাপের জন্য এনজিও থেকে দেনা করে টাকা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আরেক সমস্যায় পড়ি। মেসে থেকে পড়াশোনা করবো সেই টাকা ছিল না। সেসময় আমাদের এলাকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় মেসে উঠি। সেখানে ন্যূনতম খরচ দিয়ে থাকতে শুরু করি। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে উঠে শিক্ষকদের আর্থিক সমস্যার বিষয়টি বললে মেয়েদের একমাত্র আবাসিক হলে সিট বরাদ্দ পাই। কিন্তু সেখানে প্রতি মাসে ২৫০ টাকা করে ভাড়াও দিতে পারিনি। পরে ৬ থেকে ৮ মাস পরপর বিভিন্নভাবে সেই টাকা পরিশোধ করেছি।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার শুরু থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করেছি। প্রতি সেমিস্টারেই ভালো ফলাফল ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। এভাবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে বিভাগ এবং অনুষদে প্রথম হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পাই।
জোবেদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন কবে পূরণ হবে জানি না। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আল্লাহ তায়ালার রহমতে বর্তমানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করি। কিন্তু গত ২১ সেপ্টেম্বর সেই নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নিয়োগ সম্পন্ন করা হলেও আমাকে কোনো চিঠি, মেসেজ বা মোবাইল কল করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে আমাকে মেসেজ ও কল করা হয়েছিল। কিন্তু আমি মোবাইল বার বার চেক করেছি। গ্রামীণফোন অফিস থেকে এক মাসের কল ও মেসেজ লিস্টও বের করে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো কল বা মেসেজ পাইনি।
এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন শাখা ও আইসিটি সেলে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, নিয়োগ পরীক্ষা সংক্রান্ত চিঠি জোবেদা আক্তারের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে এবং তার দেওয়া মোবাইল নম্বরে মেসেজ ও কল করা হয়েছে।
শিপন তালুকদার/এমজেইউ