কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে চিলমারী, দীর্ঘ এই পথে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিতে হয়। পারাপারে নৌকাই একমাত্র ভরসা। আর ভরসার সেই নৌকায় ভর করে পারাপার হতে গিয়ে হাজারো মানুষের সলিলসমাধি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রে একেকটা মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে বারবার দাবি উঠে সেতু নির্মাণের। চিলমারী হতে রৌমারী পর্যন্ত সেতুর দাবিতে একাধিকবার আন্দোলনও দানা বাধে। সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস মিলে, পরিদর্শন করা হয় সেতু নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান। কিন্তু সরকার সংশ্লিষ্টদের কচ্ছপ-গতির ভাবনায় এখনো অধরা রয়েছে স্বপ্নের সেতু।

গত ২০ সেপ্টেম্বর চিলমারী-রৌমারী নৌরুটে ফেরিঘাট ও ফেরি সার্ভিস চালু হয়েছে। আপাতত এতে মানুষ ও গাড়ি দুটোই পারাপার করবে। এর ফলে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, কমেছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য জেলার সঙ্গেও চিলমারী, রৌমারী এবং রাজিবপুর উপজেলার মানুষের যোগাযোগ দূরত্বও কমেছে।

ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার নারায়নপুর দিয়ে প্রবেশ করেছে। বিশাল এ নদ কুড়িগ্রামের উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর হয়ে গাইবান্ধা জেলায় প্রবেশ করে। এ নদের নতুন প্রবাহের শুরু থেকেই রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলা কুড়িগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন। এই কারণে দীর্ঘদিন ধরে ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে সেতুর নির্মাণের দাবি করে আসছেন সুবিধাবঞ্চিত এ জনপদের মানুষজন।

ফেরিতে ফিরছে স্বস্তি, উঠছে সেতুর দাবি

কিছুদিন আগে রৌমারী থেকে রংপুরে এসেছেন শাকিল মিয়া। উদ্দেশ্য রংপুর নগরীতে ঠেলাগাড়ি করে ভাপাপিঠা বিক্রি করবে। কলেজপড়ুয়া শাকিল প্রতি বছর শীত মৌসুম শুরুর আগে নৌকায় করে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে চিলমারী হয়ে রংপুরে আসেন। তবে এবার এ যুবক নৌকায় নয় ফেরিতে করে পারাপার হয়েছেন। এ সময় শত শত মানুষের মুখে শঙ্কামুক্ত আনন্দের ফেরি যাত্রার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে শুনেছেন ব্রহ্মপুত্রে সেতু নির্মাণের জোরালো দাবির কথা।

শাকিল মিয়া বর্তমানে রংপুর নগরীতে একটি ভাড়া বাড়িতে তার এলাকার আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে থাকেন। তারা সবাই বিকেল হলে এক চাকার ঠেলাগাড়ি নিয়ে বের হন ভাপাপিঠা বিক্রির উদ্দেশ্যে। শাপলা চত্বর এলাকায় ভাপাপিঠা বিক্রির সময় কথা হলে শাকিল মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার খুব তাড়াতাড়ি নদী পার হয়েছি। কোনো ভয় লাগেনি। বরং ফেরিতে প্রথমবার উঠতে পেরে ভালো লেগেছে। যদি সরকার ব্রহ্মপুত্রে একটি সেতু করে দিত তাহলে আমাদের এলাকার উন্নয়ন হত। মানুষজনকে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ছুটতে হত না। ফেরি চালু হওয়াতে খুশি কিন্তু ফেরির চেয়ে সেতু বেশি প্রয়োজন।

শুধু শাকিল নয়, জেলার লাখ লাখ মানুষের চাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু নির্মাণ করা হোক।

চিলমারী উপজেলার সংবাদকর্মী সাওরাত হোসেন সোহেল ঢাকা পোস্টকে জানান, ফেরিঘাট চালু হওয়াতে মানুষজন আনন্দিত। কিন্তু চিলমারী হতে রৌমারী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের রেলপথসহ সেতু নির্মাণকাজের শুরুও দেখতে চান। সেতু নির্মাণের দাবির সঙ্গে চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুরসহ পুরো কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ একমত বলে জানান তিনি। এছাড়া সেতুতে গ্যাসের লাইন ও হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের দাবি করছেন তারা।

চিলমারী নৌবন্দর থেকে ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার পরপরই পণ্যবাহী যানবাহন পারাপারে ব্যাপক সাড়া মিলছে। এতে গাড়ির চাপ বেড়েই চলেছে। কিন্তু ফেরি স্বল্পতায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে পণ্যবাহী পরিবহনের চালক ও শ্রমিকরা।

ভূরুঙ্গামারী সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে পাথরবোঝাই ট্রাক নিয়ে আসা চালক রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেরি চলাচল শুরুর পর থেকে আমাদের যাতায়াত সুবিধা বেড়েছে। এখন নৌরুটে ফেরি হয়ে সহজে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছি। কিন্তু মাঝেমধ্যে ফেরি স্বল্পতার কারণে ভোগান্তিও পোহাতে হয়। কুঞ্জলতার ধারণক্ষমতা ১০টি বড় ট্রাক। অথচ পারাপারের জন্য অন্তত ১৫-২৫টি ট্রাক ফেরির অপেক্ষায় থাকে। ফেরির সংখ্যা আরও দুই-তিনটি বাড়ানো সম্ভব হলে পরিবহন মালিকরা সাশ্রয় সুবিধার জন্য ফেরিমুখী হবে।

পারাপারে কমছে দূরত্ব, ভাড়াতেও স্বস্তি

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)-এর চিলমারী নৌবন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে চিলমারী-রৌমারী রুটে নৌপথের দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটার। তবে নদের ড্রেজিং করা হলে এ পথের দৈর্ঘ্য কমে হবে ১৩ থেকে ১৪ কিলোমিটার। কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে দুটি উপজেলা রৌমারী ও চর রাজীবপুর ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এ দুটি উপজেলার মানুষকে নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা শহরে যেতে হয়। এখন ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার পর তারা নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারবেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অ্যাম্বুলেন্সের কোনো ভাড়া লাগবে না। এছাড়া অন্যান্য যানের ক্ষেত্রে ভাড়া শতকরা ১৫ ভাগ কমানো হয়েছে।

রৌমারী-চিলমারী নৌপথে ভাড়া কমানোর একটা দাবি রেখেছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সর্বসাধারণের সুবিধার জন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রস্তাবিত ভাড়া থেকে কমিয়ে সিএনজিচালিত বেবি ট্যাক্সি/অটোরিকশা ৬৬০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩০০ টাকা, মোটরসাইকেল ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ১০০ টাকা, বাইসাইকেল ১২০ টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ টাকা, জনসাধারণের জন্য প্রস্তাবিত ৮০ টাকা কমিয়ে ৫০ টাকা করা হয়েছে।

ব্রহ্মপুত্রে সেতু নির্মাণের দাবি ও সরকারের আশ্বাস

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণের দাবি বাস্তবায়নে ২০১৩ সাল থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে সভা, সমাবেশ, বিলবোর্ড স্থাপন, লিফলেট বিতরণ ও স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন আন্দোলনকারীরা। স্থানীয় সংসদ সদস্যের পাশাপাশি বিষয়টি সরকারপ্রধানের নজরে আনতে সক্ষমও হন তারা।

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সেতু কর্তৃপক্ষ গঠিত একটি টিমের অংশ হিসেবে অতিরিক্ত সচিব ও পরিচালক ড. মনিরুজ্জামান (পিএনডি), সেতু কর্তৃপক্ষের সদস্য ও প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী, সেতু বিভাগের সদস্য ও উপসচিব (বাজেট) আবুল হাসান ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। রৌমারী উপজেলার ফলুয়ারচর থেকে চিলমারী উপজেলার রমনা ঘাট, বনগ্রাম ঘাট, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের হবিগঞ্জ ঘাট এলাকা পর্যন্ত পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শন দলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন সঙ্গে ছিলেন।

পরিদর্শনে ব্রহ্মপুত্র সেতু নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, রৌমারী উপজেলার বলদমারা থেকে চিলমারী উপজেলার ফকিরের হাট পয়েন্টের দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। চররাজিবপুর উপজেলা থেকে চিলামারীর দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে বলদমারা থেকে ফকিরের হাট অ্যালাইমেন্টে ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার আয়তনের ২০০ বিঘার চর এবং আড়াই কিলোমিটার আয়তনের বাঘুয়ার বাঁশদহের চর প্রায় ৩০ বছর পূর্বে গঠিত হয়। পানির লেভেল থেকে ৮-১০ ফুট ওপর চর দুটি অবস্থিত। এখানে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার অংশ ভায়াডাক্ট এবং ৪ দশমিক ২০ কিলোমিটার জলভাগের অংশে ক্যাবল স্ট্রেইট সেতু নির্মাণের জন্য সাশ্রয়ী ও যুক্তিযুক্ত। চিলমারী থেকে রৌমারী সেতুর সঙ্গে রেলসংযোগ রাখতে মতামতও দেওয়া হয়।

এই সুখবরে আন্দোলনকারীরা অতি আনন্দিত হন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ব্রহ্মপুত্র নদে চিলমারী-রৌমারী সেতু নির্মাণ সম্পর্কিত সমীক্ষার অগ্রগতি থমকে যায়। এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় ফেরিঘাট স্থাপনের। সরকারের এ সিদ্ধান্তে সেতুর দাবি নিয়ে আন্দোলন করা মানুষজন হতভম্ব হয়ে পড়েন। তবে তাদের বিশ্বাস উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে ঠিকই স্বপ্নের সেতু নির্মাণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে।

ব্রহ্মপুত্রে সেতু হবে সেতুবন্ধনের অন্যতম মাধ্যম

ব্রহ্মপুত্রের ওপর সেতু নির্মিত হলে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। এই সেতু শুধু দেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হয়। এছাড়া যমুনা নদীর ওপর নির্মিত একমাত্র সেতু বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর চাপও কমবে। এই সেতুর ওপর দিয়ে রেল যোগাযোগ তৈরি হলে তা ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের সর্বোত্তরের জেলাগুলোকে রেলপথেও সরাসরি যুক্ত করবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল করতে ব্রহ্মপুত্র সেতু অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে।

কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আবু সুফিয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে ফেরি দিয়েছেন এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা চেয়েছি ব্রহ্মপুত্র নদে একটি সেতু করা হোক। যার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। পদ্মা সেতুতে যদি সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হয়, তাহলে ব্রহ্মপুত্র নদে কেন সেতু করা সম্ভব হবে না? বর্তমান সরকার আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ব্রহ্মপুত্র নদে সেতুর দাবি করছি। এই দাবি কোটি কোটি মানুষের প্রাণের দাবি।

চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদের কোল ঘেঁষে থাকেন সংগঠক ও লেখক বশির আহমেদ। যার দু-চোখ সাক্ষী এ নদপাড়ের মানুষের জীবনগল্পের। ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত উঠাবসা করেন। তিনি যা দেখেন তা লেখেন আর দেশ-বিদেশের মানুষকে জানিয়েও দেন। ফেরি ও সেতুর মধ্যে তিনি খুঁজেন সেতুবন্ধনের ফারাকটাও।

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে বেসরকারি কমিউনিটি গণমাধ্যম রেডিও চিলমারীর স্টেশন ম্যানেজার বশির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু হলে রৌমারী ও রাজীবপুরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে, ফলে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর চাপ কমবে। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগের একমাত্র সড়ক সেতু বঙ্গবন্ধুর সেতুর ওপর প্রায় ৪০ ভাগ পরিবহন চাপ কমে আসবে। আর সেতুতে রেল যোগাযোগ যুক্ত করলে মানুষের যোগাযোগ ব্যয়ও কমে আসবে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে।

বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচানোর তাগিদকে আঁকড়ে ধরে দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন গবেষণার পাশাপাশি সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন কুড়িগ্রামের একুশে পদকপ্রাপ্ত আইনজীবী এস এম আব্রাহাম লিংকন। তিনিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন ব্রহ্মপুত্র নদে একটি সেতু হলে বদলে যাবে কুড়িগ্রামের অর্থনীতি।

ঢাকা পোস্টকে এস এম আব্রাহাম লিংকন  বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু হলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্রে ফেরি চালু হয়েছে। আনন্দের ফেরিতে আমাদের সেতুর স্বপ্ন যেন হারিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পিছিয়ে থাকা কুড়িগ্রামকে এগিয়ে নিতে ব্রহ্মপুত্রে একটি সেতু্ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ব্রহ্মপুত্র নৌরুটে ফেরি চলাচল শুরুর দিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত মানুষের আবেগ ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো। সেখানে মানুষের দাবি ছিল যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের গাড়ি পারাপারের ভাড়া অর্ধেকের নিচে নামিয়ে আনা। তাতে যেমন সাশ্রয়ী হবে তেমনি এই নৌরুটটি দ্রুতই জনপ্রিয় হবে। তবে ফেরি নয় আমাদের লক্ষ্য ব্রহ্মপুত্রের ওপর চিলমারী-রৌমারী বহুমুখী সেতু। সে লক্ষ্য যেন ফেরি পারাপারে থেমে না যায়। বরং সরকারের আশ্বাসের সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এ সেতু যেন হয় আমাদের সেতুবন্ধনের অন্যতম মাধ্যম।

সেতু নির্মাণে যেভাবে বদলে যাবে কুড়িগ্রাম

ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু হলে কুড়িগ্রাম সোনাহাট স্থলবন্দর, চিলমারী নৌবন্দর, নীলফামারীর চিলাহাটি বন্দর, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা বন্দর, লালমনিরহাটের বুড়িমারী বন্দর এবং দিনাজপুরের হিলি বন্দরের সঙ্গে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আমূল পাল্টে যাবে। ব্রহ্মপুত্র সেতু হলে উত্তরবঙ্গের রংপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলার সঙ্গে রাজধানীর দূরত্ব প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কমে আসবে। এই সেতু দিয়ে গ্যাস সংযোগ তৈরি করা গেলে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত কুড়িগ্রামে কলকারখানার পাশাপাশি বাড়বে ব্যবসার পরিধি।

সম্প্রতি চিলমারী থেকে রৌমারীতে নৌরুটে ফেরিতে ঘুরে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি শীর্ষ দৈনিকে রংপুর ব্যুরো প্রধানের দায়িত্বে আছেন। জন্মসূত্রে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষও বটে। তবে কর্মসূত্রে বহু বছর ধরেই তার বসবাস রংপুরে।

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে রফিকুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু নির্মাণ হলে কুড়িগ্রামবাসীর ভাগ্য বদলে যাবে। হাইভোল্টেজ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন সংযোগ পেলে গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা। সৃষ্টি হবে বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের। কুড়িগ্রামের মানুষ ভিক্ষা চায় না, কুড়িগ্রামের মানুষ চায় কর্মসংস্থান। শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে শুধু কুড়িগ্রাম নয় বিভিন্ন জেলার শ্রমিক এসে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে। আমাদের জেলার শিক্ষিত বেকার যুব সমাজের ভাগ্য বদলে দিবে এই সেতু। এ দাবি আদায় হলে দূরীভূত হবে কুড়িগ্রামের অভাব।

তিনি আরও বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু না থাকায় কুড়িগ্রাম-রংপুর-বগুড়া হয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে যেতে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা ব্যয় হয়। অন্যদিকে রৌমারী শেরপুর-জামালপুর দিয়ে ঢাকা-সিলেট-ময়মনসিংহ যেতে ৫ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এই সেতু বাস্তবায়ন হলে সময় এবং অর্থনৈতিকভাবে সবাই লাভবান হবে। শুধু দেশে নয় এই সেতু হলে আন্তর্জাতিকভাবেও তা গুরুত্ব পাবে। কারণ ভারতের আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্যসহ নেপাল এবং ভুটানের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

দীর্ঘদিন ধরে নদী ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তিনি উন্নয়ন সচেতনতা বাড়াতে লেখালেখির পাশাপাশি নদীনির্ভর প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবন রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবখানে। সবুজায়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিক্ষকও কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা।

তুহিন ওয়াদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রহ্মপুত্রে সেতু নির্মাণ হলে কুড়িগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন দ্বার খোলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে নতুন মাত্রা যোগ হবে। শুধু তাই নয় একদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর চাপ কমবে ও সময় বাঁচবে, অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী পূর্ব-পশ্চিমের জেলাসমূহের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরিসহ রাজধানীর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ও নিবিড় যোগাযোগ সম্ভব হবে। সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরসমূহ জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উত্তরোত্তর অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

তিনি আরও বলেন, এই সেতু শুধু কুড়িগ্রাম নয় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। ব্রহ্মপুত্রে সেতু নির্মাণ হলে ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের যোগাযোগ সহজ হবে। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনগণের চলাচল, মালামাল পরিবহনসহ ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা গড়ে উঠার পাশাপাশি আপামর জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে এবং দূর হবে দারিদ্র্য।

হাল ছাড়েননি স্থানীয় সংসদ সদস্য

কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ইতোমধ্যে ব্রহ্মপুত্রে সেতু নির্মাণের জন্য মহান সংসদে দাবি তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে ডিও লিটার দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা সরেজমিনে কয়েকবার সেতুর সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শনও করেছেন।

এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চিলমারী থেকে রৌমারী সেতু নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে একটি চায়না কোম্পানি। ইতোমধ্যে কোম্পানিটি প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি অর্থায়ন আগ্রহপত্র জমা দিয়েছে।

২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রৌমারী উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর চিলমারী থেকে রৌমারী করিডোরে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন প্রভাব নিরূপণসংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই সভাতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেছিলেন, আমাদের দেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণ অসম্ভব না। প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামবাসীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। দেশের দারিদ্র্যপীড়িত কুড়িগ্রাম জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্রহ্মপুত্র সেতু নির্মাণ জরুরি।

ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু নির্মাণ পরিকল্পনাসহ অন্যান্য কার্যক্রমের সবশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

এমজেইউ