নওগাঁয় ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে প্রথমবারের মতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গ্রাম-বাংলার হারিয়ে যাওয়া শত বছরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) বিকেলে সাপাহারে এই আয়োজন করে উপজেলা প্রশাসন। যেখানে স্থানীয় ডিঙ্গি নৌকাসহ ১৬টি নৌকা দলের পৃথক বাইচ প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন হাজারো দর্শনার্থী।

সরেজমিনে দেখা যায়, দুপুরের পর থেকেই স্থানীয়রা তাদের ৮টি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বিলে উপস্থিত হোন। অপরদিকে বাকি ৮টি বড় নৌকা আনা হয়েছে পার্শ্ববর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আনা নৌকাদলগুলোর মধ্যে ১টি উপজেলা প্রশাসনের, ১টি উপজেলা পরিষদের এবং বাকি ৬টি নৌকা সাপাহার উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন পরিষদের হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেকটি নৌকা সুজজ্জ্বিতভাবে সাজানো এবং বাইচে অংশ নেওয়া প্রতিযোগীরা রঙ বেরঙের পোশাক পরিহিত। দুপুরের পর থেকেই ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে নৌকা বাইচ দেখতে নওগাঁ, পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাসহ দূর-দূরান্ত থেকে আসেন হাজারো নারী পুরুষ। বিকেল হওয়ার সাথে সাথে বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়কে উপচে পড়া ভিড় জমে দর্শনার্থীদের। অনেকে বিলের ভেতরে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নৌকায় ভাসমান অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে উপস্থিত হোন। যেখানে সব বয়সী নারী-পুরুষের সমাগম হয়। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নেচে-গেয়ে আনন্দ উপভোগ করেন দর্শনার্থীরা।

নৌকা বাইচ দেখতে আসা দর্শনার্থী মালিহা তাবাসসুম ও মাহিরা তিথি এসেছেন নওগাঁ শহর থেকে। তারা বলেন, জবই বিলের নাম অনেক শুনেছি। ফেসবুক-ইউটিউবেসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এর সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু পড়াশোনায় ব্যস্ততার কারণে সময় সুযোগ করে কখনো আসা হয়নি। স্থানীয় এক বন্ধুর মাধ্যমে বিলে নৌকা বাইচ হবে জেনে সকালেই চলে এসেছি। গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া নৌকা বাইচ দেখে অনেক ভালো লাগলো।

এমরান হোসেন, রবিউল ইসলাম ও আবু সাইদ এসেছেন পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে। তারা বলেন, হারিয়ে যাওয়া নৌকা বাইচ শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটা সরাসরি দেখার সুযোগ হাতে গোনা কয়েকবার হয়েছে। যেখানেই নৌকা বাইচ হয় সময় পেলে ছুটে গিয়ে দেখবার চেষ্টা করি। ১২ জন বন্ধু মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছি নৌকা বাইচ দেখতে। এখানে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বিষয় যখন রঙ বেরঙের জামা পড়ে দ্রুত গতিতে বৈঠা চালিয়ে মাঝিরা এগিয়ে যায়।

সাপাহার উপজেলার আইহাই গ্রাম থেকে আসা মোকসেদ আলম, রাসেল, মাহবুর ও রাকিব বলেন, চার-পাঁচ বছর আগে স্থানীয় উদ্যোগে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ছোটখাটো বাইচ করা হতো। তবে এবারের আয়োজন অনেক বড় পরিসরে করা হয়েছে। নৌকা বাইচ দেখার জন্য পুরো উপজেলার প্রত্যেকটি গ্রামে মেয়ে-জামাই ও আত্মীয় স্বজনদের আগমন ঘটেছে। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে এবারের সফল আয়োজন করছে উপজেলা প্রশাসন। এমন আয়োজন অব্যাহত রাখলে গ্রামীণ এতিহ্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। এটি অব্যাহত রাখা উচিত।

ঐতিহ্যবাহী এই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এছাড়াও অন্যদের মধ্যে ছিলেন খাদ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব উত্তম কুমার রায়, নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ফৌজিয়া হাবিব খাঁন, সাপাহার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হোন শিরন্টি ইউনিয়নের নৌকা দল এবং ২য় হয় উপজেলা প্রশাসনের নৌকা দল। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী নৌকা দলের মাঝে ট্রফি, চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, রানার্স আপ ট্রফি প্রদান করেন প্রধান অতিথি। এছাড়াও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলকে দেওয়া হয় শুভেচ্ছা পুরস্কার।

নৌকা বাইচের আয়োজন করার কারণ জানতে চাইলে সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন বলেন, জবই বিল কেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতিনিয়ত বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এরই একটি অংশ জবই বিলে নৌকা বাইচ। এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করায় আবহমান বাংলার চিরায়ত চিত্র ধরে রাখার পাশাপাশি পর্যটকদের কাছে জবই বিল আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এতে স্থানীয়দের জীবন জীবিকায় পরিবর্তন আসবে। আগামীতে এই আয়োজন অব্যাহত রাখা হবে।

আরমান হোসেন রুমন/এমএএস