পটুয়াখালীর আলীপুর ও মহিপুর এলাকার মাছ ধরা ট্রলার থেকে জেলেরা বছরে কমপক্ষে ১৭ মেট্রিক টন অপচনশীল বর্জ্য বা প্লাস্টিক সাগরে ফেলছেন। উপকূলের জেলেদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থা ইকোফিসের গবেষণায় দেখা গেছে, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন আলীপুর ও মহিপুর মৎস্য বন্দর এলাকা থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫০০ ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে যায়। প্রতি মাসে গড়ে একটি ট্রলার তিনবার করে সাগরে যায়। যাওয়ার সময় জেলেরা তাদের ট্রলারে চাল-ডালসহ বিভিন্ন মালামাল প্লাস্টিক ব্যাগে বা পাতলা পলিথিনে নিয়ে যান। প্রতিটি ট্রলারে গড়ে আড়াই থেকে তিন কেজি ওজনের প্লাস্টিক তারা নিয়ে যান। ব্যবহার শেষে এসব পলিথিন তারা সাগরের পানিতে ফেলে দেন।

বেসরকারি এ সংস্থাটির উদ্যোগে প্রায়ই সাগরগামী মাছ ধরা ট্রলারে পাটের বস্তা সরবরাহ করা হয় এবং জেলেদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক বা পলিথিনগুলো সাগরের পানিতে না ফেলে এ বস্তায় সংরক্ষণের অনুরোধ জানানো হয়। মাছ ধরা শেষে এসব ট্রলার থেকে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ব্যাগ, চিপস, কোমল পানি, চানাচুর-বিস্কুটের মোড়কসহ প্লাস্টিক বা পলিথিন ভর্তি বস্তাগুলো সংগ্রহ করে তার পরিমাপ করে দেখা গেছে প্রতিটি ট্রলারে দু-তিন কেজি পরিমাণ প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার করেছে জেলেরা। সে হিসেবে একটি ট্রলার মাসে কমপক্ষে তিনবার সাগরে মাছ ধরতে যায়।

৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাসহ নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে জেলেরা বছরের ৫ মাস সাগরে নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে পারেন। সে হিসেবে একটি ট্রলার বছরের ৫ মাসে কমপক্ষে ১৫ বার সাগরে যায় এবং গড়ে আড়াই কেজি করে মোট সাড়ে ৩৭ কেজি প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার করে। এতে ট্রলারগুলো কমপক্ষে ১৭ টন প্লাস্টিক বা পলিথিন সাগরে ফেলছে, যা সাগরের পরিবেশের জন্য হুমকি।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিসের ইকোফিস-২ প্রকল্পের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পৃথিবী পৃষ্ঠের ৭১ ভাগ জুড়ে রয়েছে পানি, সাগর দূষণমুক্ত রাখা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সাগর দূষণ কমানোর লক্ষ্যে ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত ওয়ার্ল্ডফিস বাংলাদেশের ইকোফিস-২ অ্যাকটিভিটির আওতায় আমরা একটি নমুনা জরিপ পরিচালনা করি এবং সাগরে জেলেদের ট্রলারে কী পরিমাণ প্লাস্টিক বা পলিথিন ফেলে সাগরের পরিবেশ দূষণ করছে, সে সম্পর্কে একটি ধারণা পাই। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক এবং সাগরের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে না পারলে মাছসহ এর নানা ধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব চরম হুমকিতে পড়বে। সমুদ্রের পরিবেশ ও ভারসাম্য রক্ষা করতে জেলেদের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে যদি তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষ নদী ও সমুদ্রের ওপরই বেশিরভাগ নির্ভরশীল। কিন্তু বিপজ্জনক প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে ফেলছে। সমুদ্রকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য সৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে আমরা ১৮-৩৫ বছর বয়সের ২০ ভাগ নারীসহ ১০০ জন যুবককে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, যারা ব্লু-গার্ড নামে পরিচিত। ব্লু-গার্ডরা ইকোফিস থেকে সমুদ্রসৈকত পরিষ্কার এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং তারা জাটকা ও মা ইলিশ না ধরা, অনুমোদিত জাল দিয়ে মাছ ধরার বিষয়ে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতেও কাজ করছেন। 

মাঝি সৈয়দ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় চাল-ডাল, কোমল পানি, বিস্কুট, চানাচুর, ককশিটসহ বিভিন্ন সামগ্রী প্লাস্টিকের ব্যাগে বা পলিথিনে ভরে নিয়ে যাই এবং ব্যবহার শেষে সাগরে ফেলে দেই। কিন্তু আমরা এখন বুঝতে পারছি যে বিষয়টি পরিবেশের অনেক ক্ষতি করছে। তবে এখন থেকে আমরা ব্যবহৃত প্লাস্টিক বা পলিথিন তীরে নিয়ে আসবো, যাতে সাগরের পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকে।

কুয়াকাটা ও আলিপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহিপুর-আলীপুর ঘাটে কমপক্ষে ৫০০ ট্রলার মাছ আহরণসহ বেচাকেনা করে থাকে। ট্রলারে ব্যবহৃত পলিথিন-প্লাস্টিক সাগর-নদীতে যেন না ফেলে সেজন্য জেলেদের তারা প্রায়ই সচেতন করছেন। আগের থেকে জেলেরা কিছুটা সচেতন হয়েছেন, আশা করছি সামনের দিনে জেলেরা সাগরের পরিবেশ ও ভারসাম্য বজায় রাখতে কাজ করবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কলাপাড়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মাননু ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলেদের উদাসীনতার কারণেই মূলত প্রতি বছর এত প্লাস্টিক সমুদ্রে যাচ্ছে। তবে যদি সমুদ্রগামী জেলেরা যে পরিমাণ প্লাস্টিক সমুদ্রে নিয়ে যাবে ব্যবহার শেষে সেটা আবার ফেরত নিয়ে আসতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা থাকতো তাহলে সমুদ্রের পরিবেশ কিছুটা হয়ত ভালো থাকতো।

এসএম আলমাস/এএএ