ছররার আঘাতে আহত শিশু মাহির চোখের অপারেশন করাতে হবে
ছেলেকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মা রোজি খাতুন। এই সুযোগে বাড়ির মাত্র শ ফিট দূরে মহাসড়ক থেকে ঘুরে আসতে চেয়েছিল শিশু মহির উদ্দিন মাহি। কিন্তু এই যাওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো তার। ওই মুহূর্তে হরতাল সমর্থনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়।
সংঘর্ষে ছোঁড়া একটি রাবার বুলেটের ছররা এসে লাগে মাহির মুখেসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে। শরীরের অন্যস্থানের ক্ষতের জ্বালা কমলেও শঙ্কা দেখা দিয়েছে চোখ নিয়ে। ইতোমধ্যে সেই চোখে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিকিৎসকরা। সোমবার দুপুরে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষুবিভাগ থেকে এই বিষয় জানানো হয়।
বিজ্ঞাপন
মহির উদ্দিন মাহি বাঘোপাড়া খোলারমাঠ এলাকার আব্দুর রব ধলুর ছেলে এবং গোকুল সরকারি বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাবা আব্দুর রব বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসে চাকরি করেন।
সোমবার সকালে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষুবিভাগে গেলে মাহি ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়। মাহি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছিল। তার ডান চোখ পুরোটা লাল। অন্য চোখে অনেকটাই আতঙ্ক। বাবা-মা জানালো শরীরে জ্বালা হওয়ার কারণে সারারাত ঠিকমতো ঘুমায়নি মাহি। সকাল থেকে একটু স্বাভাবিক।
বিজ্ঞাপন
ঘটনার বিবরণে মাহির মা রোজি খাতুন বলেন, হরতাল দেখে বড় ছেলেকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে বের হবো। ওই সময় মাহি বলল মা আমি এক মিনিটের মধ্যে আসছি। এই বলে ও দৌড়ের রাস্তার ওদিকে চলে যায়। আমি এতকিছু বুঝতেই পারিনি। কারণ অন্য ছোট ছেলেরা ওখানে আছে। আমি বাড়ির পাশের দোকান থেকে পান নিচ্ছিলাম, এমন সময় একজন এসে বলে তোমার ছেলে মারা গেছে।
আমি তার কথা মজা মনে করে উল্টো বকা দিই বলে জানান রোজী খাতুন। বললেন, তখন দুই জন মহিলা এসে বলে মাহি গুলি লেগে মরে গেছে। এই কথা শোনার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। একটু পরে জ্ঞান ফিরলে সবাই আমাকে জানায়, মাহি মরেনি। ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তখন আমিও ছুটে যাই হাসপাতালে।
মাহির বাবা আব্দুর রব বলেন, আমি সাড়ে আটটার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে অফিসে চলে আসি। এরপর সাড়ে নয়টা থেকে দশটার দিকে খবর পাই আমার ছেলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আছে। তখন অফিসে বলে আমি এখানে চলে আসি। জরুরি বিভাগের ডাক্তার জানায়, চক্ষু বিভাগে দেখাতে। তারপর টিকিট কেটে এখানে ভর্তি করাই। এরপর থেকে এখানেই আছি।
আব্দুর রব আরও বলেন, এখন ডাক্তাররা বলছেন চোখে সমস্যা আছে। একটা অপারেশন করা লাগতে পারে। পরে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন লোকজন দেখতে এসেছিলেন। তারা যেকোনো প্রয়োজনে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, মাহির চোখের জন্য গতকাল রোববার এমআরআই করা হয়েছে। সেটার রিপোর্ট নিয়ে চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শেখ আব্দুল মুক্তার ও অন্য চিকিৎসকরা যাচাই করে দেখেছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আগামীকাল মঙ্গলবার সকালে অপারেশন করা হবে।
এ বিষয়ে চক্ষু বিভাগের মেডিকেল অফিসার আরিফ হাসান বলেন, রাবার বুলেটের ছররা মাহির ডান চোখের পাশে লাগে। এতে অক্ষিগোলকের ভেতর অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ফলে তার চোখ দিয়ে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা কমে আসার শঙ্কা আছে। এজন্য একটি অপারেশন করতে হবে। আর অপারেশনের পরে আরও ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন হলে তা ঊর্ধ্বতন চিকিৎসকরা জানাবেন।
গ্রামবাসী যা জানায়
রোববার ভোর থেকে বাঘোপাড়ার খোলার মাঠ এলাকার ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে পিকেটিং শুরু করে বিএনপির লোকজন। বেশিরভাগ লোকজন ছিল বাইরের এলাকার। এ সময় স্থানীয় বাসাবাড়ির শিশু-কিশোররাও রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিল। পিকেটাররা কোনো যানবাহন সেখান দিয়ে পাড় হতে দিচ্ছিল না। ওই পথে যাতায়াতকারী মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করে পিকেটাররা। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দশটার দিকে ডিবি পুলিশের একটি টহল দল সেখানে আসে। তারা পিকেটারদের রাস্তা থেকে চলে যেতে বলে। তখন পাল্টা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে তারা। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। কিন্তু পিকেটারদের ইটপাটকেল মুখে পুলিশ পিছু হটে। তবে ওই সময় মাহিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। পরবর্তীতে হরতাল সমর্থনকারীদের কর্মকাণ্ড আবার বেড়ে গেলে পুলিশ এসে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এভাবে দুপুর পর্যন্ত কয়েক দফা ধাওয়া, সংঘর্ষ হয়।
গ্রামবাসী আজাদ আলী নামে এক ভ্যানচালক বলেন, অধিকাংশই আশেপাশের এলাকার। ওরা গাড়ি আটকাচ্ছে, ঢিল মারছে। ওদের আমরা চিনি না, ওরাও আমাদের চিনে না। আমাকেও থাকতে দেয়নি এখানে। পরে ভ্যান নিয়ে চলে গেছি। বাইরের লোকজনের জন্য এলাকার মানুষদের জান হুমকির মধ্যে পড়েছিল।
পুলিশের সূত্র জানায়, পিকেটারদের ছত্রভঙ্গ করতে শটগান থেকে ৩৫ রাউন্ড ছোররা গুলি ছুঁড়ে পুলিশ। এরমধ্যে ৩০ রাউন্ড ডিবি পুলিশ ও ৫ রাউন্ড সদর থানা পুলিশ গুলি চালায়। পরবর্তীতে এ ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সদর থানা পুলিশের ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ।
তিনি বলেন, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ১৯ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা বাদী এসআই রুম্মন হাসান। এছাড়াও আরও অনেক অজ্ঞাত আসামি রয়েছে মামলায়।
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এমএএস