‘এক কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ৩০০ টাকা’
রাজশাহী সুগার মিলস (রাচিক) চালাতে প্রয়োজন মাফিক আখ পাওয়া যায় না। এটিই লোকসানের বড় কারণ। মিলসকে লাভজনক করতে আখ চাষের বিকল্প নেই। একইভাবে চিনির পাশাপাশি বাইপ্রোডাক্ট করা গেলে সুদিন ফিরবে সুগার মিলসে।
ঢাকা পোস্টকে এভাবে বলছিলেন রাজশাহী সুগার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার। একই সঙ্গে এই কর্মকর্তা জানালেন রাজশাহী সুগার মিলস নিয়ে সরকারের পরিবকল্পনার কথাও।
বিজ্ঞাপন
রাজশাহী সুগার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার বলেন, মিলসের মূল উপদান আখ। আখের উৎপাদন যেহেতু আমাদের কম। চাষিরা আখ উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। যেহেতু অন্যান্য ফসলের দাম বেশি। তাই অন্যান্য ফসলে আবাদের (চাষের) জন্য চাষিরা ঝুঁকেছে। এখানে (রাজশাহী) মৎস্য চাষের জন্য পুকুর, ইটভাটা, নগরায়ন হওয়ার কারণে আখ আবাদযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। মিলস চালাতে গেলে যে পরিমাণ আখের প্রয়োজন, সেই পরিমাণ আখ আমরা পাই না। এটিই লোকসান হওয়ার বড় কারণ।
তিনি বলেন, এক মৌসুমে আখ মাড়াইয়ের জন্য যদি মিলস (রাচিক) রেডি (চালু) করি তাহলে প্রথমে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এই মিলস (রাচিক) একদিন চলুক বা ছয় মাস চালাক। এই বিনিয়োগ করে মিলসটা (রাচিক) রানিং (চালু) করতে হবে। যেহেতু আমার প্রাথমিক বিনিয়োগ বেশি। কিন্তু মিলস (রাচিক) আখের অভাবে বেশি দিন চালাতে পারছি না। তার কারণে লোকসানটা বেশি হচ্ছে। একমাস দুইমাস নয়, এই মিলসটা যদি পাঁচ মাসও চালানো হয়, সেই ক্ষেত্রে এই তিন কোটির সঙ্গে মাত্র কয়েক লাখ টাকা বেশি খরচ হবে। অর্থাৎ মিলস বেশি দিন চললে লোকসান ততো কম হয়।
বিজ্ঞাপন
যন্ত্রপাতির বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ১৯৬২ সালে এই মিলসটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘদিনে মিলসের যন্ত্রপাতির উৎপাদন ক্ষামতা কমেছে। দিন দিন আরও কমে যাচ্ছে। মিলসের কিছু যন্ত্রপাতি আবার নতুন রিপ্লেসমেন্ট (বদল) করা যেত, তাহলে চিনি উৎপাদন বেড়ে যেত। পুরাতন যন্ত্রপাতির কারণে যে পরিমাণ চিনি উৎপাদন হওয়ার কথা আমরা করতে পারি না। তবে এখন যে পরিমাণ আখ মাড়াই করা হচ্ছে, সেখান থেকে যে পরিমাণ চিনি পাওয়া যাচ্ছে, যন্ত্রপাতি ভালো থাকলে বেশি চিনি পাওয়া যেত। কিন্তু তারপরেও কাঙ্খিত চিনি উৎপাদন হতো না। মিলস পাঁচ মাস চলার কথা, কিন্তু চলে ২২ দিন। এই ২২ দিনে যে পরিমাণ চিনি পাওয়ার কথা তার থেকে কম পাচ্ছি মেশিনারি ত্রুটির কারণে।
তিনি বলেন, এবার সরকার আখের দাম বৃদ্ধি করেছে। আমরা আশা করছি এবার আখের চাষ বাড়বে। লক্ষ্যমাত্র ৫ হাজার একর। সাড়ে ৫ হাজার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটা হলে আগামী মৌসুমে ভালো পর্যায়ে চলে আসবে আখের চাষ। গত মৌসুমে লোকসান হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা। মিলস চলেছে ২২ দিন। আরও ২২ দিন চালাতে পারলে মিলস নো লোস নো প্রোফিটে চলে যেত। দুই বছর আগে আট হাজার টন চিনি উৎপাদন হয়েছিল। তখন লোকসান ছিল ৮৪ কোটি টাকা। এ বছর চিনি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টন। আর লোকসান হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা। চিনির দাম বার্তি। আর ২০ থেকে ২২ দিন মিলস চালানো গেলে অনেক লোকসান কমে যেত। একেবারে চলে যেতাম নো লাভ, নো লোসে।
আগের রেকর্ড তুলে তিনি বলেন, এক সময় আখ মাড়াই হয়েছে বেশি। তখন দুই লাখ টন আখও মাড়াই হয়েছে। তখনও ৮৪ থেকে ৮৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তার কারণ তখন চিনির মূল্য ছিল কম। এই কারণে এতো লোকসান হয়েছে। বর্তমানে এক কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ৩০০ টাকা। তবে উৎপাদন খরচ আবার আখ মাড়াইয়ে ওপরে নির্ভর করে। মিলস বেশি দিন চললে চিনি উৎপাদনের খরচ কমে যায়। মিলসে বেশি আখ মাড়াই করতে পারলে ৩০০ থেকে নেমে ২০০ বা ১৫০ টাকায় নেমে আসতো। আমাদের টার্গেট চিনির উৎপাদন খরচ প্রতিকেজি ১০২ টাকায় রাখা।
রাচিক নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার বলেন, কেরির মতো করার একটা প্লান (পরিকল্পনা) ছিল সরকারের। মুলাসেস থেকে স্পিরিট, অ্যালকোহল করতে পারতাম। রাজশাহী আমের এলাকা। তাই এখানে একটা ম্যাংগো জুস কারখানা বা ম্যাংগো পাল্প কারখানা করার বিষয়ে সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাবনা রয়েছে। চিনির পাশাপাশি এসব করলে মিলসটা লাভজনক হয়ে উঠবে। এই শ্রমিকদের দিয়েই চালানো যাবে। তবে কিছু শ্রমিক লাগবে সেই সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষ এমন। মিলস ২২ দিন আর জুস মিলসে ৩ মাস চালাতে পারলে খরচ কমে আসবে। বাই প্রোডাক্ট করা গেলে রাজশাহী সুগার মিলসে সুদিন ফিরবে।
শ্রমিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, মিলস চালুর সময় যারা আসবে। তারা শুধু মিলস চলাকালীন সময়ের বেতন পাবেন। গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়োগ বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয়েছে জনবল সংকট। ১ হাজার ২৪৭টি পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ৫৪১টি পদ। কর্মরতদের সঙ্গে মৌসুমী শ্রমিকরাও কাজ করে থাকেন।
রাসিক সূত্রে জানা গেছে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৪ নভেম্বর থেকে ২০২৩-২৪ মৌসুমের আখ মাড়াই শুরু হবে। সেই লক্ষ্যে সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। সুগার মিলস কর্তৃপক্ষের দাবি-গত বছরের তুলনায় এবার আখ বেশি চাষ হয়েছে। তাই এ বছর বেশি দিন চলবে সুগার মিলস। ২০২২-২৩ মৌসুমে ২৬ হাজার ৪৫ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করা হয়। এ থেকে চিনি উৎপাদন হয় ১ হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টন। এই চিনি উৎপাদন খরচ হয় ৮৩ কোটি ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। পরে উৎপাদিত চিনি ও চিটা গুড় বিক্রি করে আয় হয় ২০ কোটি ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। ফলে এই মৌসুমেও সুগার মিলের লোকসান হয় ৬৩ কোটি টাকা।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে- পশ্চিমে কাশিয়াডাঙ্গা, নওদাপাড়া, মিলস গেট ‘ক’ ও মিলস গেট ‘খ’ জোন। এই জোনগুলোতে আখের উৎপাদন একেবারেই স্বল্প। অপরদিকে রাজশাহী জেলার পুঠিয়া, নন্দনগাছী, সরদহ, চারঘাট ও আড়ানিতে আখের উৎপাদন তুলনামূলক বেশি। সে ক্ষেত্রে মিলের মোট চাহিদা এ পাঁচটি সাব জোন থেকে পূরণ হয়।
লোকসানের কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমিতে সারা বছর আখ থাকে। ফলে অন্য ফসল ফলানো সম্ভব হয় না। কিন্তু আখ ছাড়া অন্য আবাদ করলে জমিতে বছরে দুই থেকে তিনটি ফসল ফলানো সম্ভব। আখের তুলনায় অন্য ফসলে বেশি লাভ পাচ্ছে কৃষক। তাই আখ চাষে আগ্রহ কম কৃষকদের। এছাড়া আখের উৎপাদন খরচ বেশি, গুড় উৎপাদনকারীদের কাছে আখ সরবরাহ, জনবল সংকট, যন্ত্রাংশ পুরোনো হওয়ায় কার্যক্ষমতা কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত রাজশাহী সুগার মিলস। শুধু তাই নয়, সুগার মিলসের নয়টি সাব জোন রয়েছে। এর মধ্যে চারটি সাব জোনে নগরায়ণের কারণে কমেছে চাষযোগ্য জমি। ফলে কমেছে আখের চাষ।
রাজশাহী সুগার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার বলেন, আগামী ২৪ জুন মিলস চালু হবে। এ মৌসুমে ৩০ দিন মিলস চালুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪২ হাজার মেট্রিক টন। মিলস জোন এলাকায় আখের চাষাবাদ হয়েছে ৩ হাজার ৫৪০ একর জমিতে। আর গত বছর আখ চাষ হয়েছিল ৩৪ হাজার একর জমিতে। এছাড়া চিনি মজুদ রয়েছে ১২ টন।
এমএএস