ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছেন চাষি

কিশোরগঞ্জের হাওরের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে কাঁচাপাকা সোনা রঙের ধানের শীষ হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। চাষিরা পুরোদমে শুরু করেছেন এসব ধান কাটার কাজ। কিন্তু হাসি নেই তাদের মুখে। 

৪ এপ্রিল টানা সাড়ে ৪ ঘণ্টার ‘লু’ হাওয়া বয়ে গেছে জেলার ওপর দিয়ে। এতে জেলার প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধানের শীষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চিটায় পরিণত হয়েছে। তার সঙ্গে করোনার কারণে দেখা দিয়েছে মৌসুমি কৃষি শ্রমিক সংকট। বছরের একমাত্র ফসল নষ্ট হওয়ায় ভারাক্রান্ত কৃষকদের মন।

জানা গেছে, আগাম পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ফসলের ক্ষতিরোধে এবার কিশোরগঞ্জের সাতটি হাওর উপজেলায় ৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬৩ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ইতোমধ্যেই জেলার ইটনায় ২৪ দশমিক ১৩ কিলোমিটার, মিঠামইনে ৩ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার, অষ্টগ্রামে ১৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার, নিকলীতে ১৩ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার, ভৈরবে ১ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার, তাড়াইলে ২ দশমিক ১১৬ কিলোমিটার ও করিমগঞ্জে ০ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

মাঠে মাঠে চলছে ধান কাটা

নিকলীর সবচেয়ে বড় হাওরে কৃষক আলীমুদ্দীনের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফলন ভালো হয়েছে। তবে করোনায় ধান কাটতে দূর-দূরান্ত থেকে মৌসুমি কৃষি শ্রমিকের আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পরিবারের লোকজন ও এলাকার শ্রমিকদের নিয়ে ধান কাটতেছি। ধানের ন্যায্য দাম পেলে আমরা লাভবান হবো। 

তিনি আরও বলেন, ধান আবাদ করতে গিয়ে ঋণ করতে হয়েছে। তবে ভালোভাবে ধান তুলতে পারলে সব ঋণ পরিশোধ করা যাবে। আর যারা ব্রি ধান-২৯ চাষ করেছিল তাদের ধান ‘লু’ হাওয়ায় শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। তাদের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।

নিকলীর সিংপুর গ্রামের কৃষক সাদেক মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাওরে বাঁধ হয়েছে। তাই বন্যা হাওয়ার শঙ্কা কম। কষ্টের ফসল নষ্ট হলে কী যে কষ্ট এইটা বইলা বোঝাইতাম পারতাম না। এখন হাওরের দিকে ছাইয়া ছাইয়া দুই হাত তুইলা দোয়া করি, যে ধান জমিতে আছে সেই ধানের যাতে কোনো ক্ষতি না অয়।’ এই আকাঙ্ক্ষা শুধু আমার একার নয়, পুরো হাওরবাসীর।

মাটজুড়ে সোনা ধান কাটায় ব্যস্ত চাষি

কৃষক আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধানতো ভালই হয়েছে। তবে ভয় একটাই করোনার জন্য যদি বিদেশি শ্রমিক আসতে না পারে। তবে খেতের ধান খেতে পঁচবে। নেতারা যে ধান কেটে দিবে, এরতো ছবি তুলতো আইবো। হেরা ধান কাটটারতোনা।

কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (খামার বাড়ি) উপ-পরিচালক সাইফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিশোরগঞ্জের হাওরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫০ হেক্টর এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭১ লাখ ১৫ হাজার ৮৩ টন। গত ৪ এপ্রিল টানা সাড়ে চার ঘণ্টা গরম ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান গাছের পরাগ রেণুসহ শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, খবর পেয়ে এরই মধ্যে ঢাকা থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকসহ কৃষি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। তাদের নির্দেশক্রমে ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণসহ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পরবর্তীতে সে তালিকার ভিত্তিতে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, কৃষি শ্রমিকের সংকট কাটাতে সরকার ৬০ ভাগ ভর্তুকি দিয়ে গত বছর ধান কাটার ৪৮টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ও ২৩টি রিপার দিয়েছেন। এ ছাড়া এ মৌসুমের জন্যও ভর্তুকির ৩৯টি হার্ভেস্টার বরাদ্দ রয়েছে।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে গত বছরের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারও ধান কাটতে বহিরাগত মৌসুমি কৃষি শ্রমিক হাওরাঞ্চলে প্রবেশ ও পরিবহনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসপি