মা-বাবার সঙ্গে জান্নাতী

জান্নাতীর নানা অসুস্থ। তাই নাতনিকে বিয়ে দিয়ে নাতজামাইয়ের মুখ দেখে মরতে চান। প্রাথমিকে মেধাবৃত্তি পাওয়া জান্নাতী তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। সে মোতাবেক নানা-নানি প্রবাসী এক পাত্রের সঙ্গে জান্নাতীর বাল্যবিবাহ ঠিক করেন। বিয়েতে অবশ্য জান্নাতীর মায়েরও অমত ছিল না। কিন্তু জান্নাতী বেঁকে বসলেন বিয়েতে।

জান্নাতীর সংকল্প, এত অল্প বয়সে তিনি বিয়ে করতে মোটেই রাজি নন। তার স্বপ্ন লেখাপড়া করে নিজের পায়ের দাঁড়াতে হবে। এ জন্য কেঁদেকেটে নিজের ইচ্ছের কথা বলেছিলেন বাবাকে। মেয়ে যেহেতু লেখাপড়ায় যথেষ্ট ভালো, তাই মেয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন বাবা। বন্ধ হলো বিয়ের সব চিন্তাভাবনা।

এ ঘটনার কয়েক মাস পর জেএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এ পরীক্ষায়ও তিনি মেধাবৃত্তি পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য জেএসসির এই সাফল্যের পর আর কোনো স্বজন জান্নাতীর বিয়ের ঘটকালি করতে আসেননি।

পরে জান্নাতী আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করেন।

কিন্তু কে জানত, দরিদ্র পরিবারের সেই অদম্য মেয়েটি মেডিকেলে উত্তীর্ণ হবেন? ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন জান্নাতী।

চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার আসাননগর গ্রামের খোরশেদ আলম বাবলু ও ফাতেমা আক্তার দম্পতির সন্তান জান্নাতী। তিন বোনের মধ্যে জান্নাতী বড়। খোরশেদ আলম বাবলু সদ্য সরকারীকৃত আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। বাড়ির সামান্য জমি ছাড়া চাষাবাদের একচিলতে জমিও নেই। তার স্বল্প আয় দিয়েই চলে পুরো সংসার, চলে তিন মেয়ের লেখাপড়া।  মা ফাতেমা আক্তার নিপুণ গৃহিণী।

জানা যায়, জান্নাতী প্রথমবার মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন। তবে সেবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ভর্তি হয়েছিলেন জুওলজিতে। কিন্তু মন যে তার পড়ে ছিল মেডিকেলের বইয়ের ভেতর। তাই এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো আবার তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। দ্বিতীয়বার ঠিকই উত্তীর্ণ হয়েছেন। ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে। দ্বিতীয়বার পরীক্ষার দরুন ৫ নম্বর কেটে নেওয়ার পরও তার জাতীয় মেধাতালিকায় স্কোর দাঁড়িয়েছে ২৭০।

শুধু দারিদ্র্য না, সমাজের নানা অনিয়মের সঙ্গেও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর জান্নাতীর। তিনি বলেন, একবার পরীক্ষার হলেও অপ্রিয় ঘটনা চরম মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার নির্ধারিত সময় শেষ। আমাদের কাছ থেকে উত্তরপত্র নিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিদর্শক শিক্ষক কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে সময় শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে ১০ মিনিট করে অতিরিক্ত সময় দিয়েছিলেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। শুধু কি এইচএসসি পরীক্ষা? মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েও অনিয়ম দেখেছি। যন্ত্রণায় হৃদয় ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারিনি। এসব অনিয়ম আমার ভেতরে বড় হওয়ার জেদ সৃষ্টি করেছে।

জান্নাতী বলেন, আমার এ সাফল্যের পেছনে শিক্ষকদের অনেক অবদান রয়েছে। বিশেষ করে আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আনিসুজ্জামান ও আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের শিক্ষক ফারুক হোসেনের সহযোগিতা কোনো দিন ভলব না। অন্য শিক্ষকরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। বাবা কলেজের স্টাফ। তাই প্রাইভেট পড়িয়েছেন বিনা মূল্যে। হাইস্কুলে পড়াকালীনও প্রাইভেট শিক্ষকরা অর্ধেক টাকা নিয়েছেন।

আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কৃষিবিদ গোলাম ছরোয়ার মিঠু ও প্রভাষক তাপস রশীদ নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, জিজ্ঞেস করতেন। তাদের কাছেও কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। মা-বাবার অনুপ্রেরণার পাশাপাশি শিক্ষকদের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ আমার সাফল্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাদের ভালোবাসা ও স্নেহ সব সময় আমাকে সাহস জুগিয়েছে। লক্ষ্যে স্থির থাকলে এবং সঠিক পরিকল্পনায় আন্তরিকভাবে পড়াশোনা করলে সাফল্য নিশ্চিত। দারিদ্র্য কিংবা অন্য সমস্যা তাকে স্থির লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।

অনেকে বলেন, গ্রামের শিক্ষার্থীরা খুব বেশি সাফল্য পায় না। কারণ, গ্রামে তেমন সুযোগ নেই। তাদের এ কথা হয়তো কিছুটা সঠিক। তবে সবটা নয়। আমিই তার প্রমাণ। আমি উপজেলা মফস্বল কলেজে পড়লেও বসবাস করেছি গ্রামে। গ্রাম থেকেই আমি সাফল্য পেয়েছি, বলেন জান্নাতী।

জান্নাতীর বাবা খোরশেদ আলম বাবলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, জান্নাতী ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। পড়াশোনার প্রতি খুবই একনিষ্ঠ ছিল সে। আমি খুব ছোট চাকরি করি। ও এতটা মেধাবী না হলে আমার পক্ষে পড়ানো সম্ভব ছিল না। শুধু জান্নাতী না, আমার আরও দুই মেয়ে লেখাপড়া করছে। জান্নাতীকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে গিয়ে অনেক শিক্ষক সহযোগিতা করেছেন। কলেজের কোনো শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে টাকা নেননি। হাইস্কুলের শিক্ষকরাও খুব সহযোগিতা করেছেন। আজকের আনন্দের দিনের তাদের সহযোগিতার কথা স্মরণ করছি। তবে কোনো আত্মীয় মেয়ের লেখাপড়ার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেননি।

তিনি আরও বলেন, মেয়েকে শুধু একটা কথাই বলব, একদিন তুমি অনেক বড় হবে। কিন্তু মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলবে না। কেউ যেন টাকার অভাবে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে তোমার কাছ থেকে ফিরে না যায়।

এনএ