দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ।

রোববার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

কুমিল্লার ১১টি আসন থেকে মোট ৮৯ জন মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছিলেন। ১১ আসনে দুই সংসদ সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কুমিল্লা-১ আসন থেকে সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবং কুমিল্লা ৮ আসন থেকে নাছিমুল আলম চৌধুরী নজরুলকে বাদ দিয়ে কুমিল্লা-১ আসনে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এবং কুমিল্লা ৮ আসনে নতুন মুখ এজেডএম শফিউদ্দিন শামীমকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-তিতাস) আসনে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুস সবুর। এর আগে এ আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন মেজর (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া। তাকে বাদ দিয়ে এবার এ আসনে নৌকার মাঝি করা হয়েছে আব্দুস সবুরকে। ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর টানা তিনবারের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। এছাড়া তিনি প্রকৌশলীদের শীর্ষ সংগঠন ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউশন অব বাংলাদেশ (আইআইবি) এর সভাপতি ছিলেন।

কুমিল্লা-২ (হোমনা-মেঘনা) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিমা আহমাদ মেরিকেই পুনরায় মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সেলিমা আহমাদ মেরি। তিনি হোমনা উপজেলার বাসিন্দা। দেশের বিখ্যাত নিটল-নিলয় গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উইমেন্স চেম্বার অব কমার্সের বর্তমান সভাপতি।

কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনকেই নৌকার মাঝি হিসেবে বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ বিষয়ক সম্পাদক। ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতি থাকা ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান তিনি। কিন্তু মনোনয়ন না পেয়ে মুরাদনগর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। তাতে জয়লাভও করেন ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন। পরে আবার তাকে দলে টেনে নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি জয়লাভ করেন।

কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলকেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এর আগে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হয়ে জয়ী হন। পরে আওয়ামী লীগ তাকে দলে টেনে নেয়। ২০১৮ সালে তিনি বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে পরাজিত করে দ্বিতীয় দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবুল হাসেম খানকে আবারও নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের জুনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন তিনি। এই আসনে সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু পাঁচবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। আব্দুল মতিন খসরুর মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে নৌকার মাঝি হন অ্যাডভোকেট আবুল হাসেম খান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তার উপরই আস্থা রেখেছে আওয়ামী লীগ।

কুমিল্লা-৬ (সদর) আসন থেকে টানা তিনবার এবং বর্তমান সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের হাতেই নৌকার বৈঠা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই আসনটি বিএনপি অধ্যুষিত ছিল। সাবেক নৌমন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন বীরপ্রতীক এ আসনের পাঁচবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। আকবর হোসেন বীর প্রতীকের মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী হন হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াছিন। সে সময় আওয়ামী লীগের মনোনীত হন আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার এবং প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পর থেকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আছেন। কর্মীবান্ধব এ সংসদ সদস্য বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।

কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ২০২১ সালের উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। তিনি সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক মো. আলী আশরাফের মৃত্যুর পর আসনটি শূন্য হলে উপনির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। এর আগে প্রয়াত আলী আশরাফ এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, এসকিউ গ্রুপের চেয়ারম্যান এজেড এম শফিউদ্দিন শামীমকে। এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নাছিমুল আলম চৌধুরী নজরুলকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবার।

শফিউদ্দিন শামীম একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি দেশের স্বনামধন্য এসকিউ গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এ জেড এম শফিউদ্দিন কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং কুমিল্লা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপণন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট স্কটল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ জেড এম শফিউদ্দিন শিক্ষাজীবন শেষে পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হন। তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এসকিউ গ্রুপ। এ গ্রুপের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ২৩টি শিল্পকারখানা, যেসব প্রতিষ্ঠানে ছয় হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে এ জেড এম শফিউদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেন এসকিউ ফাউন্ডেশন, যার মাধ্যমে সমাজের বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, আত্মকর্মসংস্থান ও জীবনমান উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন। এছাড়া তিনি নিজ এলাকায় অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদসহ বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় নির্মাণ করেছেন।

কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনে আবারও নৌকা তুলে দেওয়া হয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের হাতে। এর আগে তিনি এ আসন থেকে টানা তিনবারসহ মোট চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের পর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা তাজুল ইসলামকে।

কুমিল্লা-১০ (সদর দক্ষিণ-লালমাই-নাঙ্গলকোট) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি এ আসনে টানা তিনবারসহ মোট চারবারের সংসদ সদস্য। তিনি ১৯৭০ সালে তদান্তীন সমগ্র পাকিস্তানের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১ম স্থান অর্জন করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে কমার্সে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া আইন শাস্ত্রেও তিনি স্নাতক ডিগ্রির অধিকারী।

তিনি প্রথম ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০০৮, ২০১৪ এবং সবশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় দেশের ১১তম অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান।

এছাড়া ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার সময় বাংলাদেশে ২০১১ এ অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেট সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এই আসরটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১) আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করার গৌরব লাভ করে। ২০১৪ সালের ১ জুলাই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা (আইসিসির) নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এর আগে তিনি আইসিসির সহ-সভাপতি, অডিট কমিটির সভাপতি এবং এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক রেলমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ, মুজিবুল হক মুজিবকে এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি এ আসনের টানা তিনবারসহ মোট চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

মুজিবুল হক মুজিব স্কুলজীবনেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন। ছাত্র রাজনীতি শেষে তিনি যুবলীগে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পরে কুমিল্লা জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি মূল সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দেন।

তিনি বর্তমানে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের হুইপ ছিলেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত এবং পুনরায় হুইপের দায়িত্ব পান। তিনি সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

আরিফ আজগর/এমজেইউ