ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে ভারতে পাচার করা হয়েছিল টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের মা, দুই মেয়ে ও শিশু ছেলে সন্তানকে। মানবপাচারে শিকার হওয়া একই পরিবারের সেই চারজন আজ দেশে ফিরেছেন।

এর আগে পাচার হওয়া মা-মেয়ে ও শিশু সন্তান নিয়ে ঢাকা পোস্টে  ‘ভারতে কারাবন্দি মা ও দুই মেয়ের দেশে ফেরার আকুতি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক মাইগ্রেশন তাদের দেশে ফেরত আনার কাজ শুরু করে। পরে তাদের পরিচয় ও জাতীয়তা নিশ্চিতকরণের পর স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ভারতের হাইকমিশনের সহযোগিতায় অবশেষে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়।

দেশে ফেরত আসা মা-মেয়ে ও শিশু উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের বাসিন্দা।

শনিবার (২৫ নভেম্বর) দুপুরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি থেকে বাংলাদেশের তামাবিল সীমান্ত চেকপোস্ট দিয়ে তারা প্রবেশ করে। গুয়াহাটির বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের মাধ্যমে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া দেশের অন্যান্য জায়গার আরও ছয়জনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

হস্তান্তরের সময় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের জরুরি সহায়তা হিসেবে খাবার, জরুরি কাউন্সেলিং সেবা ও অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়। এসব সহায়তা তাদের হাতে তুলে দেন সিলেটের তামাবিল ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রনু মিয়া এবং ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম কর্মকর্তারা।

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জোয়াই ডিস্ট্রিক্ট জেলের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট বাটস্কামেম ননিবারি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের উপ-ব্যবস্থাপক শায়লা শারমিন প্রমুখ।

পাচার হওয়া ১১ বছর বয়সী আফজাল (ছদ্মনাম) আঠারো মাস জেলে থাকায় বাংলায় আর কথা বলতে পারে না। কিছুটা হিন্দি, কিছুটা খাসিয়া, কিছুটা ইংরেজিতে কথা বলছে ছোট্ট এই শিশু।

মা ও মেয়ে বলেন, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দালালরা আমাদের ভারতে পাচার করে দেয়। বিক্রির উদ্দেশ্যে মেঘালয়ের একটি এলাকায় রাখার সময় পুলিশ আমাদের আটক করে। এরপর সেখানকার আদালত ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে আমাদের ৯ মাসের কারাদণ্ড দিয়ে জোয়াই জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। পরে সেখানেই আমরা কারাভোগ করি। পরে সুযোগ পেয়ে পরিবারকে জানালে তারা জানতে পারে আমরা ভারতে বন্দি আছি। পরে ভারতে পাচার হওয়ার সংবাদ প্রচার হয়। এরপর ব্র্যাক মাইগ্রেশন আমাদের দেশে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়।

তারা আরও বলেন, যিনি আমাদের মতো অসহায়দের নিয়ে সংবাদ করেছে এবং ব্র্যাক দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করেছে আমরা তাদের কাছে ঋণী। আমরা পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি।

মেয়েদের বাবা আনন্দে কেঁদে ফেলেন বলেন,  পরিবারের সদস্যদের ফেরত পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আজকে আমার বাড়িতে ঈদের আনন্দ চলছে। যে সাংবাদিক সংবাদ প্রচারসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তার ঋণ শোধ করতে পারব না।

দুই মেয়ের একজন বলেন, স্বপন নামের এক যুবকের সঙ্গে আমার কথা হতো। একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্ক হয়। আমার পরিবারের অভাবের কথা জেনে স্বপন আমাকে বলে সিলেটে তার কাছে গেলে আমাকে আর আমার পরিবারের লোকজনকে ২৫ হাজার টাকার চাকরি দিতে পারবে। ব্যাপারটি আমার মাকে বললে তিনিও বিশ্বাস করেন। কিন্তু তখনো আমার ধারণা ছিল না স্বপন মানবপাচারের দালাল।

তামাবিল ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রনু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায়ই আমরা এই ধরনের ঘটনা দেখতে পাই। এই ধরনের ঘটনা থামাতে আমাদের আরও সচেতনতা প্রয়োজন।

ঢাকা পোস্টকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জোয়াই ডিস্ট্রিক্ট জেলের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট বাটস্কামেম ননিবারি বলেন, দুই প্রান্তের দালালদের খপ্পরে পড়ে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করে। বৈধপথে না আসায় আটক হয় তারা।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর শরিফুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের স্থল সীমান্ত পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম সীমান্ত। ফলে মানব পাচারকারীরা এই সুযোগে নেয়। নানা প্রলোভন দেখিয়ে বা বিদেশে কাজের কথা বলে ভারতে নেয়। ব্র্যাক নিরাপদ অভিবাসন এবং মানবপাচার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কাজ করে যাচ্ছে।

অভিজিৎ ঘোষ/এমজেইউ