রূপকথার মতো এক গ্রাম নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া। এ গ্রামের শতভাগ মানুষ শিক্ষিত। শুধু শিক্ষিত নয়, এখানে এসএসসি পাস করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। দেশ-বিদেশে এ গ্রামের শত শত উচ্চশিক্ষিত ও পেশাজীবী মানুষ সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। এ গ্রামে নেই বাল্যবিবাহ, যৌতুক বা অসামাজিক কার্যক্রম। শতভাগ স্যানিটেশন ব্যবস্থা আছে গ্রামটিতে। এখানে নেই কোনো কোন্দল, হিংসা ও বিদ্বেষ।

৬০০ পরিবারের বসবাস হুলহুলিয়া গ্রামে। গত ২০০ বছরে এই গ্রামে কোনো পুলিশ আসার প্রয়োজন হয়নি। এমনকি মামলা-মোকদ্দমার কোনো রেকর্ডও নেই এই গ্রামের মানুষের। সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমেই সুরাহা হয় সব সমস্যার।

তাই হুলহুলিয়া গ্রাম ঘুরে এলে আপনি মানবিক ও সামাজিকভাবে আলোকিত হতে পারেন। আদর্শ গ্রামভাবনা আপনার মনেও নাড়া দিতে পারে। কারণ, এটি বাংলাদেশ তথা এশিয়ার শ্রেষ্ঠ মডেল গ্রাম

রাজধানী ঢাকা থেকে ২১৫ কিলোমিটার, নাটোর জেলা সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা শান্ত এক গ্রাম হুলহুলিয়া।

১৯৪০ সালের ১ জানুয়ারি হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ গঠিত হওয়ার পরপরই পরিষদের মাধ্যমে গ্রামের নিজস্ব ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। এ ছাড়া পাঁচজন উপদেষ্টা থাকেন কমিটিতে। দুই বছর পরপর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। পরিষদ গ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক ব্যবস্থা পরিচালনা করে।

১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে বিচারক প্যানেল গঠিত হয়ে আসছে। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এই প্যানেল আলোচনার মাধ্যমেই তা মীমাংসা করে। বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত না হলে থানা বা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না কারোরই। আর বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা আছে বলে তারা পরিষদের ওপরই নির্ভর হন। এমন আস্থাই পরিষদের বড় সাফল্য বলে মনে করে গ্রামের বাসিন্দারা।

ব্রিটিশ আমল থেকে হুলহুলিয়া গ্রামে নিজস্ব ব্যবস্থা চালু আছে। এ নিয়েও গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। গ্রামের নিজস্ব ব্যবস্থায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোঁড়ামির কোনো ঘটনা নেই।

১৮৬৯ সালে হুলহুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। কিন্তু উচ্চবিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর অনেকেই ঝরে পড়ত। পরিষদের উদ্যোগ আর গ্রামের মানুষের চেষ্টায় ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। শুরুতে শিক্ষকদের অনেকেই বিনা বেতনে বা অর্ধেক বেতনে শিক্ষাদান করেছেন। পরে এখানে একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালনায় দুটি স্কুল চলছে।

চলনবিলবেষ্টিত হওয়ায় আগে বর্ষা মৌসুমে নৌকাই ছিল এ গ্রামটির যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তবে পরিষদের চেষ্টায় এখন সারা বছর সড়কপথেও যাওয়া যায় এই গ্রামে। সবার সহযোগিতায় হুলহুলিয়ায় গড়ে উঠেছে মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছে ডাকঘর ও দাতব্য চিকিৎসালয়।

কীভাবে যাবেন
ঢাকার কল্যাণপুর বা গাবতলী থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, ন্যাশনাল পরিবহন প্রভৃতি বাসে যাওয়া যায় নাটোর। ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৮০০ টাকা।

এছাড়া রাজশাহীগামী যেকোনো বাসেই নাটোর যাওয়া সম্ভব। ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন একতা এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে নাটোরে যাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৩৪০ টাকা (শোভন শ্রেণি), জনপ্রতি ৭৫৬ টাকা (এসি)।

তারপর নাটোর থেকে বাস বা সিএনজিযোগে সিংড়ায় যেতে ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা। সিংড়া সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে সিএনজিযোগে টাওয়ার বাজার মোড় যেতে ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা, টাওয়ার মোড় থেকে ভ্যানযোগে যেতে হবে রূপকথার হুলহুলিয়া গ্রামে, ভাড়া জনপ্রতি ৫ টাকা।

কোথায় থাকবেন
ভ্রমণপিপাসুদের থাকার জন্য হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের রয়েছে বিনা মূল্যে দুটি রুম। সেখানে নিরিবিলি ও মনোরম পরিবেশ।

এ ছাড়া সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে নাটোর জেলা শহরের চকরামপুরে। মাদ্রাসা রোডে হোটেল উত্তরা, মাদ্রাসা মোড়ে হোটেল মিল্লাত, কানাইখালীতে হোটেল আরপি। এ ছাড়া কানাইখালীতে হোটেল রুখসানাতে থাকা যেতে পারে। ভাড়া ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে।

কীভাবে বেড়াবেন
হুলহুলিয়ায় অবশ্যই পাঁয়ে হেঁটে বেড়াতে হবে। চাইলে ভ্যানযোগেও যেতে পারবেন সব জায়গায়। 

খাওয়ার ব্যবস্থা
এখানে খাবারের কোনো হোটেল বা রেস্তোরাঁ নেই। তবে পাঁচ-সাতজন হলে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ বিনা মূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করে। আর সংখ্যায় বেশি হলে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা পরিষদ করে দেবে কিন্তু খরচ নিজেদের বহন করতে হবে। নাটোরে এসে নাটোরের কাঁচাগোল্লা আর বিলের প্রাকৃতিক মাছ খেতে ভুলবেন না যেন। সম্ভব হলে পরিবার আত্মীয় বা বন্ধুকে নিয়েও আসতে পারেন।

কী কী দেখবেন হুলহুলিয়ায়
বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার ব্যবহারকারী ও প্রোগ্রামার, সার্ভিস ডিভিশনের সাবেক পরিচালক পরমাণুবিজ্ঞানী হানিফউদ্দিন মিয়ার বাড়ি এই হুলহুলিয়া গ্রামে। এছাড়া রয়েছে অর্ধশতাধিক পুকুর, মাটির দোতলা বাড়ি, চলনবিল, ধানক্ষেত ইত্যাদি। হুলহুলিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নিয়ামত খাল। এর পাড়ে ঘুরে দেখতে পাবেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া হুলহুলিয়া গ্রামে আছে ডিজিটাল হাব। সেটাও প্রদর্শন করতে পারবেন।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল তৌফিক পরশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দর্শনার্থীদের জন্য আমরা গ্রামে বেশকিছু নিদর্শন গড়ে তুলতে চাই, এমন অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে যারা ঘুরতে আসবেন, তাদের সার্বিক নিরাপত্তা আমাদের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে দেওয়া হবে।

এনএ/জেএস