২০২০ সালে ভোটার তালিকায় নাম উঠেছে হামিদা আফরোজার। এর মাঝে গত বছর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকারের সুযোগ পেয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও এবারই প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন কারমাইকেল কলেজের অনার্স পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী। ভোট নিয়ে আগ্রহ থাকলেও একটি কারণে তার মন খারাপ। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন পাঁচ বছর পর একবার করে হয়। এটা আনন্দ, উৎসব এবং উচ্ছ্বাসের বিষয়। অথচ এবার প্রচার-প্রচারণা দেখে একবারও মনে হয়নি সংসদ নির্বাচন হচ্ছে।

একদিন পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। এরইমধ্যে শেষ হয়েছে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা। ভোটকেন্দ্রে পৌঁছেছে নির্বাচনী সরঞ্জামও। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করতে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এখন শুধু ভোটগ্রহণের অপেক্ষা। পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের মতো প্রথমবার সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন এমন ভোটাররাও বেশ উজ্জীবিত। যদিও নির্বাচন নিয়ে কারো কারো আবার রয়েছে ভিন্ন মতামত। রংপুরের একাধিক তরুণ নারী ভোটারের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে।

নগরীর ২১নং ওয়ার্ডের হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা হামিদা আফরোজের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তাদের মহল্লায় প্রার্থীদের কাউকে ভোট চাইতে আসতে দেখেননি। একজন নতুন ভোটার হিসেবে তিনি ভেবেছিলেন প্রার্থীরা ভোট চাইতে আসবেন। তখন তাদের কাছে কিছু দাবি-দাওয়ার কথা বলতাম। কিন্তু ভোটার হিসেবে সেই সুযোগ হয়নি। প্রচার-প্রচারণা শেষ হলেও প্রার্থীর দেখা পাইনি। তারপরও সংসদ নির্বাচনে নতুন ভোটার হিসেবে নির্ভয়ে ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি রয়েছে তার।

এবার প্রথম ভোটাধিকার প্রদান করবেন পীরগঞ্জের বড় আলমপুর গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী শামীমা আকতার। এ কারণে তারমধ্যে একটা বাড়তি উচ্ছ্বাসও দেখা গেছে। এই নবীন ভোটার বলেন, ভোট দেওয়া আমার নাগরিক অধিকার। আমি ভোট দিলেও নির্বাচন হবে না দিলেও হবে। তবে আমার অনুভূতিটা আমি তখনই অনুভব করতে পারব যখন কিনা আমি নিজের ভোটটা নিজেই দিতে পারব। এখন বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন রকমের কথাবার্তা শুনছি। কখনো কখনো ভয় লাগে, আবার মনে হয় কিছুই হবে না। যখন ভোটার ছিলাম না তখন থেকেই এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন ভোটার হয়েছি তাই সুযোগটা নষ্ট করতে চাই না।  

কথা হয় মিঠাপুকুর উপজেলা পায়রাবন্দ এলাকার একটি প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকের সঙ্গে। সেখানে চাকরিতে নতুন যোগদান করেছেন নুসরাত তারেফীন নামের এই নতুন ভোটার। প্রথমবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাওয়া এই নারী বলেন, ভালো পরিবেশে ভোট দিতে চাই। প্রার্থীদের যোগ্যতা বিবেচনার পাশাপাশি অতীতের কর্মকাণ্ড দেখেই ভোট দেব। মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান হিসেবে আমাদের এলাকা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যে প্রার্থী সহায়ক ভূমিকা রাখবে তাকেই নির্বাচিত করা উচিত বলে আমি মনে করি।  

আরেক নতুন ভোটার ফারজানা ময়েজ ববি বলেন, ভোট দিতে সবাই চায়। আমিও চাই ভোট দিতে। কিন্তু ভোটটা দিতে পারব সেটার তো এখন গ্যারান্টি নেই। নতুন ভোটার হিসেবে আমার উচ্ছ্বাস, আগ্রহ, আবেগটা একটু বেশি হবার কথা। এখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যদি বিবেচনায় ভোটের উৎসবমুখর পরিবেশ নেই। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ কথা নির্বাচন কমিশনার বলে আসছেন। তবে ভোট সুষ্ঠুভাবে হবে কিনা সংশয় রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যখন ভোটার হইনি তখন থেকেই দেখে আসছি ইউপি নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচন, সব নির্বাচনেই সহিংসতার ঘটনা ঘটে আসছে। জ্বালাও-পোড়াও, মানুষকে পুড়িয়ে মারা, কত ধরণের সহিংসতা, নাশকতা হচ্ছে। কোনো মৃত্যুর বিচার আমরা লক্ষ্য করিনি। নিশ্চয়ই ভোটের থেকে আমার কাছে আমার জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই সবদিক বিবেচনা করে যদি বলি, আমি ভোট দিতে আগ্রহ হারাচ্ছি। তবে ভোটের দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পরিস্থিতি থাকলে ভোট দিতে যাব এটাও নিশ্চিত।

এদিকে রংপুর জেলায় পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি। ভোটার বাড়লেও ভোটকেন্দ্র বিমুখ হয়ে পড়ছেন নারী ভোটাররা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ক্রমেই ভোটের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়েছেন তারা। আর সে আগুনে এবারও ঘি ঢেলেছে বিএনপিসহ সমমনা দলের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত। এতে করে ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আগাম শঙ্কা চেপে বসেছে জেলার এবারের মোট ভোটের অর্ধেকেরও বেশি ভোট ব্যাংকে।

২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী রংপুরের মোট জনসংখ্যা ৩১ লাখ ৬৯ হাজার ৬১৫ জন। এর মধ্যে নারী ১৬ লাখ ৬৭ জন এবং পুরুষ ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬০৮ জন। সবশেষ ভোটার তালিকা অনুসারে জেলার ৬টি সংসদীয় আসনে ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে নতুন ভোটার রয়েছে ৫ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) রংপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোশফেকা রাজ্জাক বলেন, যেকোনো নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা। আর ভোটাররা সেই প্রাণভোমরার একটি বড় অংশ। নতুন বা পুরাতন যেই হোক, সবার মধ্যে ভোটদানে আগ্রহ, উদ্দীপনা ও উৎসাহ বাড়াতে হবে। তরুণ ও নবীন ভোটাররা যাতে ভোট বিমুখ না হয় সেই দিক যেমনটা দেখতে হবে। একই সঙ্গে আগ্রহ হারানোর কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথও খুঁজতে হবে। কারণ নতুন ও তরুণরাই আগামীর উন্নত বাংলাদেশের শক্তি।

এদিকে প্রার্থীরা বলছেন, নবীন-প্রবীণ সব শ্রেণিপেশার ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণে সব প্রস্ততি নেওয়া হয়েছে। বিশৃঙ্খলা করলে কেউ ছাড় পাবে না।

রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি মো. আব্দুল বাতেন বলেন, রংপুরের সংসদীয় ছয়টি আসনের ৮৫৮টি কেন্দ্রের মধ্যে জেলা পুলিশের অধীনে ৬৫৯টি এবং মেট্রোপলিটন ‍পুলিশের অধীনে ১৯৯টি কেন্দ্র রয়েছে। এরমধ্যে রংপুর জেলার ৬৫৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩১৯টি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে পুলিশ-আনসারের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বিশেষ নজরদারি রাখা হবে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত টহল টিম থাকবে। একই সঙ্গে বাড়ানো হবে স্ট্রাইকিং ফোর্স ও ভ্রাম্যমাণ টিমের সংখ্যাও।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরপিএমপি) কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান জানান, নির্বাচন কমিশনার ও পুলিশের আইজিপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও  শান্তিপূর্ণ করায় বদ্ধপরিকর। এ ঘোষণার সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রংপুর মহানগর এলাকার মোট ১৯৯টি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরপিএমপির ১ হাজার ১১৪ জন, পিটিসি রংপুরের ৭৮ জন, এপিবিএন’র ১৫০ জন এবং শিল্প পুলিশের ১২২ জনসহ মোট ১ হাজার ৪৬৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা-ফোর্স এবং আনসার-ভিডিপির ২ হাজার ৩৮৮ জন সদস্য মহানগর এলাকার দায়িত্ব পালন করবে।

অন্যদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে রংপুর-১ আসনে ৯ জন, রংপুর-২ আসনে ৩ জন, রংপুর-৩ আসনে ৬ জন, রংপুর-৪ আসনে ৩ জন, রংপুর-৫ আসনে ৮ জন এবং রংপুর-৬ আসনে ৭ জনসহ মোট ৩৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জেলায় মোট ভোটার ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার রয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার ৩৯৪ জন। পুরুষ ১২ লাখ ১২ হাজার ৮৭ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ২৪ জন ভোটার রয়েছে। জেলার মোট ৮৫৮টি ভোটকেন্দ্রের ৫ হাজার ১৭৬টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন।

রংপুর জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যে সকল প্রকার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অপ্রীতিকর ঘটনায় ছাড় দেওয়া হবে না। সাধারণ কেন্দ্রে বা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা নির্বাচন কমিশন থেকে গাইডলাইন দেওয়া আছে। আমরা সেই গাইডলাইন ফলো করব। তা ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে যা প্রয়োজন আমরা সবই করব, সেই প্রস্তুতি আমাদের আছে।

আরকে