হাসপাতালে আইসিইউ বঞ্চিত মা কবরে শান্তিতে ঘুমিয়ে
মাহমুদা খাতুনের কবর
করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউর অভাবে মারা যাওয়া মাহমুদা খাতুনকে নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার ছেলে কবি মোহন রায়হান।
রোববার (১৮ এপ্রিল) বিকেল ৩টার দিকে মায়ের মৃত্যু নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন তিনি। এতে মায়ের শেষ আকুতির কথা জানান কবি মোহন রায়হান।
বিজ্ঞাপন
ফেসবুকে স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, আমার মা যে কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলেন, সে কয়েকদিন বারবার নাক থেকে অক্সিজেনের নল খুলে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আকুতি জানাতেন। শেষ মুহূর্তে আমার হাত ধরে ওই একটি আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও।’
একটা আইসিইউর জন্য আমি যখন একবার ইনচার্জের রুম, আরেকবার পরিচালকের রুমে ছোটাছুটি করেছি; তখন মায়ের করুণ আকুতি কানে বেজেছিল বার বার। অবশেষে মাকে বাড়ি নিয়ে এসেছি। কিন্তু হৃদস্পন্দনহীন নিথর চির ঘুমের নিস্তব্ধতায়। তাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসেছি, কিন্তু আমার চোখের সামনে স্থির হয়ে আছে সেই দৃশ্য, যেখান থেকে আমার বেরোনোর উপায় নেই।
বিজ্ঞাপন
রাত সাড়ে ১০টায় মাকে নিয়ে আমরা যখন সিরাজগঞ্জে গ্রামের বাড়ি পৌঁছালাম। রোজা, করোনা উপেক্ষা করে শত শত নারী, পুরুষ, শিশু, যুব, বৃদ্ধ অপেক্ষা করছিল বাড়ির সামনে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে মাকে খাটিয়ায় রাখা মাত্র চারদিক থেকে মানুষের শোকের মাতমে রাত কেটে যায়।
আমার মা আশপাশের সব এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম সাথী ও ভরসা ছিলেন। মানবদরদী, পরোপকারী বিশেষত গরিব ও দুঃখী মানুষের একান্ত আশ্রয় ছিলেন তিনি। সেই মাকে শেষ নজরে দেখার জন্য আমরা কাউকে নিবৃত্ত করতে পারিনি। লকডাউন উপেক্ষা করে গভীর রাতে মায়ের জানাজায় প্রায় দুই হাজার মানুষে ভরে গেল হাটবয়ড়া স্কুল মাঠ।
আমাদের ইচ্ছা ছিল রাতেই মাকে বাড়ির সামনে দাদির কবরের পাশে দাফন করার। কিন্ত করোনা পরিস্থিতির কারণে এত রাতে যান চলাচল না থাকায়, অনেকে আসতে পারেননি। সবার অনুরোধে তাই সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। সকাল ১০টায় তাকে সমাহিত করা হয় রহমতগঞ্জ কবরস্থানে। যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমার অকাল প্রয়াত বড়ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ আলম মধু, ট্রাকচাপায় নিহত আমার ৩৯ বছরের বোন ফৌজিয়া, গাড়িচাপায় নিহত ছয় বছরের ভাতিজা বর্ণসহ সব নিকট আত্মীয়।
৭০ বছর বসবাসের বাড়ি ছেড়ে মাকে যেতে হলো শহরের একটি হাসপাতালের হিমঘরে। এত প্রিয় এই বাড়িতে তার আশ্রয় হলো না। হায়রে মানব জীবন। এরই জন্য এত বাহাদুরি? ধনসম্পদ-অর্থের জন্য এত চাতুরি, আহাজারি।
আমার সোনার মা, জীবনে যাকে কোনো অন্যায় করতে দেখিনি, লোভ-লালসা, মোহ, স্বার্থপরতা যাকে কখনো স্পর্শ করেনি। জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যিনি কেবল ইহলৌকিক সেবা ও পারলৌকিক অর্জনের সাধনায় নিজেকে ব্যাপ্ত রেখেছেন। সারাক্ষণ স্রষ্টার ইবাদতে নিবেদিত এক অসীম অসাম্প্রদায়িক মানুষ আমার মা। পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, ঘৃণা নয়, জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের ফারাক না করে কেবলই ভালোবেসে গেছেন মানুষকে।
আমার সেই মানবী মাকে অনন্তকালের জন্য মাটিচাপা দিয়ে তারই বাড়িতে তাকে ছাড়া ফিরে এলাম এই প্রথম। হাসপাতালের আইসিইউ বঞ্চিত মা আমার, কবরের চিরশান্তির আইসিইউতে ঘুমিয়ে আছেন।
শনিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে কবি মোহন রায়হানের মা মাহমুদা খাতুনের মৃত্যু হয়। কবি মোহন রায়হানের মা মাহমুদা খাতুনের মৃত্যুর খবর শুনে মারা গেছেন তারই ছোট বোন সেলিনা খাতুন।
গত ৩ এপ্রিল মাহমুদা খাতুনের নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাস পজিটিভ আসে। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ১৬ এপ্রিল তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সিরাজগঞ্জের খোকসাবাড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বড় ছেলে প্রয়াত মাহমুদ আলম মধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে রৌমারী ক্যাম্প কমান্ডার ও স্বর্ণপদকজয়ী জাতীয় ক্রীড়াবিদ। তার দ্বিতীয় ছেলে কবি মোহন রায়হান। মাহমুদা খাতুন পাঁচ ছেলে ও তিন কন্যার জননী। সিরাজগঞ্জ দিয়ারপাচিল ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে খলিসাকুড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এএম