নির্বাচন অফিসের ভুলে না মরেও ভূত হয়েছেন বজলুর রহমান

যশোরের ঝিকরগাছা পৌরসভার কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক মো. বজলুর রহমান। তিনি উপজেলার সেন্ট লুইস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক। তবে ভুলবশত জাতীয় পরিচয়পত্রে সেটা শুধু বজলুর রহমান হয়ে যায়।

যা সংশোধন করতে নির্বাচন অফিসে গেলে জানতে পারেন তিনি ‘মৃত’। নির্বাচন কর্মকর্তার কথা শুনে তিনি বিস্মিত হন। ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি চলতি বছরের ডিসেম্বরে অবসরে যাচ্ছেন। স্কুলের বেতন ও অবসরভাতা নিয়ে এখন কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে তার।

শুধু বজলুর নয়; একই অবস্থা যশোরের চৌগাছা উপজেলার মুদিদোকানি হাফিজুরেরও। নির্বাচন অফিসে গিয়ে জানতে পারেন ২০১৯ সালে তিনি মারা গেছেন। তাদের মতো জীবিত থেকেও মৃত হয়ে জীবনযাপন করছেন ঝিকরগাছার কৃষক আব্দুল জলিল, গৃহিণী মর্জিনা বেগমসহ জেলার আরো অনেকে। এতে ক্ষুব্ধ তাদের স্বজনরা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, যশোরে নির্বাচন অফিসের ভুলে না মরেও ভূত হয়েছেন তারা। জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানো হচ্ছে নির্বাচন অফিসের সার্ভারে। ফলে বেঁচে থেকেও নাগরিক সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

জানা যায়, গেল ৩ মাসে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এমন ২০ জন ব্যক্তি এখন পুনরায় জীবিত হওয়ার জন্য নির্বাচন অফিসে ধরনা ধরছেন। তবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বলছেন, এটা পরিবারের সদস্য বা জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যের কারণে হতে পারে। বিষয়টি সমাধানে তারা কাজ করছেন।

শিক্ষক বজলুর রহমান বলেন, ‘২০০৮ সালে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পান। এরপরে জাতীয় ও স্থানীয় কয়েকটি নির্বাচনে তিনি বিভিন্ন কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন। তবে ২০০৮ সালের পর তিনি নিজে আর ভোট দিতে যাননি। এ বছরের শেষে তিনি অবসরে যাবেন। ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) আওতায় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এ জন্য সঠিক তথ্য দিয়ে অনলাইনে ইএফটি ফরম পূরণ করতে হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম সঠিক নেই। নাম সংশোধনের জন্য তিনি প্রথমে স্থানীয় তথ্যসেবা কেন্দ্রে যান। পরে গত ১৭ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে নিজের ‘মারা যাওয়ার’ খবর জানতে পারেন। তাকে জানানো হয়, “২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তার মৃত্যু হয়েছে।”

মুদিদোকানি হাফিজুর

‘ওই দিনই তিনি তার ‘মৃত স্ট্যাটাস’ পরিবর্তন করে ভোটার তালিকায় নাম পুনরায় অন্তর্ভুক্তির জন্য নির্বাচন কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের এমন ভুলের কারণে করোনার টিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। স্কুলের বেতন ও অবসর ভাতা নিয়ে এখন কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে।’ বলেন তিনি।

বজলুরের মতো একই উপজেলার কৃষক আবদুল জলিল। আইডিকার্ডের জন্য আর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতেই পারেননি তিনি। ২০০৮ সালে তিনিও জাতীয় পরিচয়পত্র পান। ভোটও দিয়েছেন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে। কিন্তু ২০১৬ সালে মাগুরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি তিনি।

তখন তিনি মনে করেছিলেন, ভুল করে হয়তো কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় তার নাম আসেনি। এরপর ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৯ সালের ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও তিনি ভোট দিতে পারেননি।

বিষয়টি নিয়ে অবশেষে তিনি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। সেখানে গিয়েই নিজের ‘মৃত্যুর’ খবর পান।

আবদুল জলিল বলেন, ‘অফিসে গেলে আমাকে বলে, “আপনি তো মরে গেছেন। কম্পিউটারে আপনাকে মৃত ঘোষণা করেছে।” পুনরায় জীবিত হওয়ার জন্য আমি গত ১৯ জানুয়ারি অফিসে কাগজপত্র জমা দিছি। এখনো সংশোধন হয়নি।’

ভোটার তালিকার তথ্য অনুযায়ী, ঝিকরগাছার কামারপাড়া গ্রামের মর্জিনা বেগম ও চৌগাছার মুদিদোকানি হাফিজুরও মারা গেছেন। তালিকায় মৃত থেকে জীবিত হওয়ার জন্য তারাও নিজ নিজ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেছেন। তারাও দ্রুত এই সমস্যা থেকে মুক্তি চেয়েছেন।

সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, তালিকায় ‘মৃত’ হওয়া বজলুর ও জলিলের বিষয়ে কোনো তথ্য অফিসে পাওয়া যায়নি। তবে মর্জিনার কর্তন ফরম-১২ (ভোটার তালিকার নাম কর্তনের আবেদন) পাওয়া গেছে।

তিনি আরো বলেন, ‘তিনজনের নাম ভোটার তালিকায় পুনরায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সুপারিশসহ আবেদনপত্র নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে পাঠানো হয়। পরিবারের সদস্য বা জনপ্রতিনিধিদের তথ্য ভুল থাকার কারণে এমনটি হতে পারে। সমাধানে তারা কাজ করছেন।’

জাহিদ হাসান/এমএসআর