এক সময়ের কৃষিজীবী মানুষের আশীর্বাদ ছিল খুলনার ডাকাতিয়া বিল। এই বিলে ধান, সবজি ও মাছ উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করতো অনেকেই। কিন্তু গেল ১৫ বছরে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। স্থায়ী জলাবদ্ধতা আর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে তলিয়ে গেছে বিলের জমি। আর বৃষ্টির সময়ে মরার ওপর খড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। তখন মৎস্য চাষিদেরও বিপাকে পড়তে হয়। ফলে ডাকাতিয়া বিলটি এখন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে স্থায়ী সমাধানের দাবি এখানকার মানুষের।

কৃষকরা জানিয়েছেন, খুলনার ফুলতলা, ডুমুরিয়া এবং যশোর জেলার অভয়নগর, কেশবপুর উপজেলা নিয়ে বিল ডাকাতিয়ার বিস্তৃতি। বিলটিতে চাষাবাদযোগ্য ৩০ হাজার একর জমি রয়েছে। বিগত ১৫ বছর ধরে জলাবদ্ধতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। আর গত ৫ বছর ধরে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের কৃষিজীবী অনেক মানুষ পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ অন্যত্র চলে গেছে।

স্থানীয়রা জানায়, বিল ডাকাতিয়ার অনেকগুলো পকেট গেট রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর ইউনিয়নের মোজারগুটা, কৃষ্ণনগর, বটভিরা গ্রাম নিয়ে মোজারগুটা বিল। স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এ তিনটি গ্রামের কয়েক শ কৃষিজীবী পরিবারকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। জমি থাকলেও তাতে ফসল উৎপাদন করতে না পারায় মাঝে মধ্যে তাদেরকে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়। এ ছাড়া স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের দুর্ভোগের শেষ নেই। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে দুর্ভোগের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়।

বিল ডাকাতিয়ার কৃষিজীবী আব্দুল ওহাব বলেন, বিলে আগে সবজি, মাছ ও ধান উৎপাদন হতো। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে সেইভাবে এখন আর হয় না। মাছ চাষ করা যায়, তবে বর্ষার সময়ে তলিয়ে যায়। এ জন্য ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।

মোজারগুটা গ্রামের কৃষক প্রভাত মন্ডল বলেন, এখানকার সবাই বিলের জমিতে চাষাবাদ করে জীবন জীবিকা চালায়। কিন্তু স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে আমাদের সে জীবিকা দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমার জমি থাকলেও না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। প্রত্যেক বছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ বছর আমার ৩টি ঘেরের মাছ ভেসে প্রায় তিন লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

মোজারগুটা গ্রামের অধিবাসী ও কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের শিক্ষক গণপতি মন্ডল বলেন, নদী নালা নেই। এখন পানি নিষ্কাশনের আর কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে বহু লোকের বসবাস, বহু জমিজমা। এই এলাকায় যদি ফসল না হয় তাহলে তো এলাকার মানুষ সব না খেয়ে মারা যাবে। এ বছর আমার নিজের ৩টা মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে। সব মিলিয়ে ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঋণী হয়েছি। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হোক।

একই গ্রামের কৃষক পল্টু মন্ডল বলেন, বিল ডাকাতিয়া তলিয়ে যাচ্ছে। আমরা ধান চাষ, মাছ চাষ, সবজি চাষ কিছুই করতে পারছি না। বর্ষা মৌসুমে রাস্তায় পানি উঠে যায়।

স্থানীয় ইউপি সদস্য রমেশ চন্দ্র বৈরাগী বলেন, মোজারগুটা কৃষ্ণনগর বিলের মাঝখানে প্রায় ৪০০ বিঘার মতো জমি আছে। ১৫০টির মতো কৃষিজীবী পরিবার আছে। বর্তমানে নদীতে পলি পড়ে নাব্যতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে বিল ডাকাতিয়ায় ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা নেই।

তিনি বলেন, বিল ডাকাতিয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল। বিল ডাকাতিয়ার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ হচ্ছে শোলমারি সুইচগেট সংস্কার করা। এর ফলে নদীর নাব্যতা ফিরে পাবে। এই এলাকায় ফসল উৎপাদনের জন্য এমপি এবং বিএডিসির সহযোগিতায় মোজারগুটা কৃষ্ণনগর সেচ প্রকল্পের আওতায় ৫টি সেচ পাম্প বসানো হয়েছে। এর ফলে এই এলাকার ১৫০টি পরিবার উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)’র খুলনা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জামাল ফারুক জানান, বিল ডাকাতিয়া এলাকার জলাবদ্ধতা দীর্ঘ দিনের। বিল ডাকাতিয়ার অনেকগুলো পকেট গেট আছে, যেগুলোর জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকেরা চাষাবাদ করতে পারে না।

তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়। বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসনে এ কর্মসূচির আওতায় ৩ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পটির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাড়ে চার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রকল্পের অর্থ দিয়ে বিল ডাকাতিয়ায় ১৮ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। খাল খননের ফলে শোলমারি সুইচগেট দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয়েছে। ৫০টি এলএলপি পাওয়ার পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ হেক্টর জমি চাষাবাদের আওতায় এসেছে।

মোহাম্মদ মিলন/এএএ