গাজীপুরের শ্রীপুর থানা পুলিশের হেফাজত থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে আনা এক ব্যক্তি  পালিয়ে গেছেন। পরে পুলিশ রাতভর অভিযান চালিয়ে ওই ব্যক্তিকে না পেয়ে তার ছেলেসহ তিনজনকে আটক করেছে বলে অভিযোগ স্বজনদের। গতকাল বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাত ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। 

এ তাদের আটকের বিষয়ে বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টা পর্যন্ত গাজীপুরের পুলিশ সুপার ও শ্রীপুর থানার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পুলিশের হাতে আটকের পর পালানো ব্যক্তির নাম রফিকুল ইসলাম (৪২)। তিনি শ্রীপুর পৌরসভার দক্ষিণ ভাংনাহাটি গ্রামের চাপিলাপাড়া এলাকার মৃত শরাফত আলীর ছেলে।  

রফিক পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুলিশ রফিকুল ইসলামের ছেলে জাহিদুল ইসলাম (২১), রফিকুলের ভাগিনা শ্যালকের ছেলে উপজেলার বরমী ইউনিয়নের তাঁতীসুতা গ্রামের আমিনুল ইসলাম, একই গ্রামের স্থানীয় মসজিদের সাইফুল ইসলামের ছেলে সিয়ামকে (১৮) আটক করে নিয়ে আসে পুলিশ।

পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়া রফিকুল ইসলামের বড় ভাই জয়নাল আবেদীন জানান, গত সোমবার (৫ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ৩টার দিকে শ্রীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম মোল্লার দক্ষিণ ভাংনাহাটি গ্রামে বাড়িতে গুলি ও বারান্দায় পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মঙ্গলবার শ্রীপুর থানায় চারজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন নুরে আলম মোল্লা। 

তিনি জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাড়ির পাশে ক্ষেত দেখতে যায় রফিকুল ইসলাম। এ সময় ওই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রফিকুল ইসলামের মুখে রুমাল চেপে আটক করে নিয়ে যায় শ্রীপুর থানা পুলিশ। রাতে থানা হেফাজতে রফিকুল ইসলামকে দেখতে গেলেও তার সাথে দেখা করতে দেয়নি পুলিশ। পরে বুধবার সকালে নাস্তা নিয়ে থানায় গেলে রফিকুল ইসলামের সাথে দেখা করতে না দিয়ে নাস্তা পুলিশ বুঝে নেয়। পরে রফিকুলের পরিবারে পক্ষ থেকে আদালতে গেলেও রফিকুল ইসলামকে আদালতে তোলা হয়নি। 

জয়নাল আবেদীন বলেন, আমরা ফিরে এসে রাত ৯টার দিকে থানায় গিয়ে রফিকুল ইসলামের খোঁজ করতে থাকি। এ সময় থানার এক পুলিশ সদস্য জানান, রফিকুল ইসলামকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এখন আপনারা দেখা করতে পারবেন না। এ কথা বলার পর আমার ভাতিজা জাহিদের কাছে খাবার রেখে এসে চলে আসি। পরে রাত ১১টার দিকে ভাতিজা জাহিদের কাছ থেকে এক পুলিশ সদস্য খাবার বুঝে নিয়ে জাহিদকে চলে যেতে বলে।

তিনি আরও বলেন, বুধবার রাত ১২টার দিকে দুই গাড়ি দিয়ে ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য রফিকুল ইসলামের দক্ষিণ ভাংনাহাটি গ্রামের বাড়িতে যায়। এ সময় রফিক ও জয়নালের পরিবারের ৬-৭ জন সদস্যকে এক ঘরে আটকে রাখে। তাদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য ছিল পোশাকে, বাকিরা ছিল সাদা পোশাকে। তাদের এক ঘরে আটকে সবার মোবাইল জব্দ করে দুই ভাইয়ের বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘এতক্ষণ যা করেছি, এখন সত্যি কথা বলি। বাড়িতে আসবে বলে, থানা থেকে পালিয়ে এসেছে। আমরা যদি মরি, আপনাদের সবাইকে নিয়েই মরবো।’

জয়নাল জানান, পরে রফিকুলের ছেলে জাহিদকে নিয়ে রফিকুলের শ্যালক প্রবাসী রুহুল আমিনের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানেও রফিকুল ইসলামকে না পেয়ে প্রবাসীর স্ত্রী জেসমিন আক্তারকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। পরে বুধবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে তাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে রফিকুলের প্রবাসী শ্যালকের ছেলে আমিনুল ইসলাম, তাদের প্রতিবেশী সিয়ামকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।

বৃহস্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্তও জাহিদ, আমিনুল ও সিয়াম শ্রীপুর থানার ভেতর পুলিশের হেফাজতে আছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার। 

জয়নাল আবেদীন বলেন, রফিকুলের এক ছেলে ও তিন মেয়ে। তার ছেলে ও মেয়েও স্থানীয় একটি কারখানায় কাজ করেন। আমাদের জানা মতে তার নামে কোনো মামলা নেই। অথচ তাকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হলো। পরে আমরা জানলাম গত  সোমবার শ্রীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বাড়িতে গুলির ঘটনায় অজ্ঞাত আসামির তালিকায় তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এতেও আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। পরে যখন দেখতে পেলাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না, তখনই মূলত আমাদের চিন্তা বেড়ে যায়। তাহলে রফিকুল এখন কোথায়? এর মধ্যে পুলিশ বাড়িতে এসে তার ছেলে ও আরও দুই আত্মীয়কে তুলে নিয়ে গেছে, বলেছে রফিকুলকে পাওয়া গেলে তাদের ছাড়বে। বিনা অপরাধে কেন ছেলেগুলোকে নিয়ে এভাবে আটকে রেখেছে। শুনেছি তাদের নাকি নির্যাতনও করা হয়েছে। পুলিশের কারণে এখন তো আমাদের পুরো পরিবারও আতঙ্কে আছে। আমাদের দাবি কোনো অন্যায় না থাকলে তাদের ছেড়ে দেন আর রফিকুল কোথায় আছে আমাদের সন্ধান দেন। 

রফিকুলের মেয়ে ঋতু আক্তার বলেন, বাবাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে এখনো আমরা তার সন্ধান পাইনি। পুলিশের কাছ থেকে পালিয়েছে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা আমাদের নানাভাবে হয়রানি করছে। আমি একটি কারখানায় কাজ করি। আমার মুঠোফোনে বেতন এসেছে সেটাও তুলতে পারিনি, মুঠোফোনও  পুলিশ নিয়ে গেছে। আমার ভাই তো কোনো অপরাধ করেনি, অন্য আত্মীয়রা তো কোনো অপরাধ করেনি এখন বাবাকে এনে দিতে তাদেরকেও পুলিশ  তুলে নিয়ে গেছে। আমরা কার কাছে এর বিচার চাইব?

থানায় আটক করে আনা জাহিদের বোন ফাতেমা আক্তার বলেন, রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত আমার দুই বোন, চাচি, আমার বাবা জয়নাল আবেদীনকে এক কক্ষে আটকে রাখে পুলিশ। এ সময় আমাদের সবার মোবাইলও নিয়ে রফিকুল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমার চাচার খোঁজ চায় তারা। পরে পুলিশকে বলা হয়, চাচাকে তো আপনারা নিয়ে গেছেন, এখন সে কোথায় আছে। এমন কথার পর পুলিশ সদস্যরা বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে রফিকুলকে থানায় বুঝিয়ে দিতে হবে। না হলে কেউ ভালো থাকবে না।

রফিকুলকে খুঁজতে রাতেই বরমী ইউনিয়নের তাতীসুতা গ্রামে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় তাতীসুতা গ্রাম থেকে সিয়ামকে আটক করা হয়। সিয়ামের চাচা রায়হান বলেন, মল অভিযুক্ত আমাদের কেউ না, আমরা তাকে চিনিও না। সিয়াম রাতে তার ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। এ সময় পুলিশ পরিচয়ে ঘরের দরজা খুলতে বলে। এত রাতে পুলিশ পরিচয় দেওয়ায় সিয়াম ভয় পেয়ে পাশের বাড়ির চাচাকে ফোনে বিষয়টি জানায়। পরে চাচাকে প্রশাসনের লোক হলে দরজা খোলার জন্য বলে। দরজা খুললে সিয়ামকে পুলিশ বলে, তুমি ফোন করে মূল অভিযুক্তকে সরিয়ে দিয়েছো, এখন তার আত্মীয়ের বাড়ি আমাদের নিয়ে যাও। এই কথা বলে সিয়ামকে ঘর থেকে নিয়ে যায় পুলিশ।

এ  বিষয়ে বক্তব্যের জন্য রফিকুলকে আটকের সাথে সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। দুপুরের পর থেকেই থানার ভারপ্রাপ্ত  কর্মকর্তা, পরিদর্শক (তদন্ত), পরিদর্শক অপারেশন ও কালিয়াকৈর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। মুঠোফোনও রিসিভ করেননি কেউ। 

তবে সন্ধ্যার পর পরিদর্শক (তদন্ত) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সারাদিনতো বিভিন্ন কথা শুনেছেন। নতুন করে কী বলার আছে। থানায় আসেন বলে ফোন কেটে দেন তিনি।   

এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম বলেন, কাউকে কোনো অভিযোগে আটক করা হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে হাজির করার বিধান রয়েছে। আর পুলিশের কাছ থেকে আসামি পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন ঘটনার বিষয়ে আমাকে কেউ অবহিত করেনি। খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

আরএআর