ভারতের মুর্শিদাবাদের ময়া নৌবন্দর থেকে বাংলাদেশের রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জ নৌবন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া হতো। তবে ৫৯ বছর ধরে এই পথে বাংলাদেশ-ভারতে পণ্য আনা-নেওয়া বন্ধ ছিল। এরপর থেকে পণ্য আনা-নেওয়া হতো সড়ক ও রেলপথে। এতে পণ্য পরিবহন খরচও বেশি হতো। সম্প্রতি খুলছে এ নৌ-বন্দরটি। ফলে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগ পর্যন্ত সুলতানগঞ্জ-ময়া ও গোদাগাড়ী-ভারতের লালগোলা নৌঘাটের মধ্যে নৌপথে বাণিজ্য চালু ছিল। পরবর্তীতে রুটটি বন্ধ হয়ে যায়। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সীমান্তের সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। উদ্বোধনের পরে রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ ঘাট নদী বন্দরের মর্যাদা পাবে। সুলতানগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে সময় ও খরচ দুটোই কমবে। এতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, বছরে এই নৌপথে দুই দেশের মধ্যে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে।

এর আগে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ধুলিয়ান নৌরুটে বাণিজ্য চালুর। রাজশাহী থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার একটি নৌপথের অনুমোদন থাকলেও পদ্মার নাব্যতা সংকটের কারণে কার্যকর করা হয়নি। ফলে রুটটি সংক্ষিপ্ত করে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ থেকে ভারতের মুর্শিদাবাদের ময়া নৌবন্দর পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে ২০ কিলোমিটার পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে পণ্য আনা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুরুতে এই নৌপথে ভারত থেকে পাথর বালি ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী আনা হবে।

বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জ ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, নৌবন্দর করার লক্ষ্যে বেশ জোরেসোরে কাজ চলছে। পণ্য আনা নেওয়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা। পল্টুন তৈরি কাজও শেষের দিকে। পাশেই রাখা হয়েছে বিশাল আকৃতির একটি ট্রলার। এই ট্রলার দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতে পণ্য পাঠানোর কথা রয়েছে। নৌবন্দর ঘাটের পাশে রাখা আছে সারি সারি ইট। পলি মাটিতে এই ইট দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হবে।

সুলতানগঞ্জ ঘাটে কাজের তদারকি করছিলেন বিআইডব্লিউটিএ উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম। তিনি জানান, দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। আগামী সোমবার এই নৌবন্দরে উদ্বোধন করা হবে। এখানে নৌ ও পরিবহন মন্ত্রণালয় বিশাল প্রজেক্ট ঘোষণা করবে। এখানকার জায়গাগুলো অধিগ্রহণ করা হবে। সরাসরি মহাসড়কের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। এই নৌরুটে নাব্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এখানে অনেক পানি আছে। পণ্য পরিবহন শুরু হলে চর আর থাকবে না। ড্রেজিং করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুলতানগঞ্জ থেকে ময়া নৌঘাটের নদীপথে দূরত্ব মাত্র ১৭ কিলোমিটার। সুলতানগঞ্জ নৌ-ঘাটটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণের পদ্মার শাখা নদী মহানন্দার মোহনার কাছাকাছি। সারা বছর সুলতানগঞ্জের এই পয়েন্টে পানি থাকে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের ময়া নৌ ঘাটটি মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমা শহরের কাছে ভারতীয় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সঙ্গে যুক্ত। ফলে সুলতানগঞ্জ-ময়া পথে নৌবাণিজ্য শুরু হলে পরিবহন খরচ অনেকাংশে কমে যাবে।

এই নৌবন্দর চালু হলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান বলেন, এক সময় এখানে নৌবন্দর ছিল। অনেকদিন থেকে বন্ধরটি বন্ধ আছে। এখানে নৌবন্দর চালু হলে স্থানীয় বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এটি ইতিবাচক। স্বাধীনতা যুদ্ধের ছয় বছর আগে এই বন্দর বন্ধ হয়ে যায়। চালু থাকা অবস্থায় বিশাল বিশাল জাহাজ আসতো এখানে। সুলতানগঞ্জ ঘাটের পশ্চিমদিকে বিশাল ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে এই বন্দর করলে আরও ভালো হতো। সেখানে সরকারি খাস জায়গা পড়ে আছে। আর কিছুদূর পরই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শুরু। সেখান থেকেও সরাসরি সড়কে উঠা যাবে।  

সুলতানগঞ্জ ঘাটের চা দোকানি মো. সেলিম হোসেন বলেন, ঘাটে প্রতিদিন ৫০টি নৌকা যাওয়া আসা করে। ভোর থেকে নৌকা চলাচল শুরু হয়ে চলে রাত আটটা পর্যন্ত চলে। এখানে বন্দর করা হলে সবসময় মানুষের যাতায়াত থাকবে। তখন ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও গতি আসবে। 

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত নৌপ্রটোকলের আওতায় নদীপথে দুই দেশের মধ্যে কম খরচে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। রাজশাহীর সুলতানগঞ্জে নৌবন্দরের কার্যক্রম চালু হলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ময়া নৌবন্দরের সঙ্গে নদীপথে বাণিজ্য শুরু হবে। এর ফলে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই উপকৃত হবেন। সুলতানগঞ্জ-ময়া একটি লাভজনক ও চমৎকার নৌরুট হতে পারে। দুই পাড়েই অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে সুলতানগঞ্জ বন্দর চালু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে সেগুলো ঠিক করা হবে। ভারত ময়া ঘাটও প্রস্তুত করেছে। উদ্বোধন হলে পণ্য পরিবহন শুরু হবে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ভারতের মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান থেকে গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ, রাজশাহী, পাকশী হয়ে আড়িচাঘাট পর্যন্ত এই নৌরুটটি। দীর্ঘদিন এটির ব্যাপারে কোনো  উদ্যোগ ছিল না। আমি গত পাঁচ বছর থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, লেখালেখি বা ডিও লেটার দেওয়ার কাজ করেছি। এর ফলে এটা গতিশীল হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ উভয়পক্ষ বিশেষ করে ভারত নৌ পথে বাণিজ্য করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ হয়ে ভারতের উত্তরপূর্ব সীমান্তের সাতটি প্রদেশ আছে সেগুলোতে সুলভে মালামাল পৌঁছে দিতে তারা নৌ পথে বাণিজ্য করতে চাই।

তিনি আরও বলেন, ভারতের পক্ষ মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান, ময়া নৌবন্দর সম্পন্ন প্রস্তুত করে রেখেছে। সুলতানগঞ্জে একটি পল্টুন নিয়ে আসা হয়েছে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। পাঁচটি নৌযানের মাধ্যমে ট্রায়াল দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করা হবে। রাজশাহীর পশ্চিমে একটি নৌ-বন্দর হতে যাচ্ছে। 

মেয়র বলেন, বর্ষাকালে দুই থেকে আড়াই হাজার টন কার্গো যাতায়াত করতে পারবে। আর খরা মৌসুমে সেটি ৭০০ থেকে ৮০০ টনে দাঁড়াবে। এ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ যথেষ্ট আগ্রহী ও আন্তরিক। এর ফলে রাজশাহী-নবাবগঞ্জ অঞ্চলের মানুষ অর্থনীতি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। ভারত থেকে লাখ লাখ টন পাথর বাংলাদেশে নিয়ে আনতে হয় সড়ক পথে ও ট্রেনে করে। এতে খরচও বেশি হয়। নৌপথে পাথর আনতে পারলে খরচ অনেক কমে যাবে। পাশাপাশি এই নৌরুটটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। 

শাহিনুল আশিক/এএএ