ফরিদপুর আদালতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভার্চুয়ালি সাক্ষ্য দিলেন বিচারক
ফরিদপুরে দুটি মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে ভার্চুয়ালি সাক্ষ্য দিয়েছেন বিচারক মো. হারুন অর রশীদ। তিনি ২০০৯-২০১০ সালে ফরিদপুরে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় নগরকান্দা থানা ও মধুখালী থানার দুটি ডাকাতির মামলায় দুই আসামির জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় নথিভুক্ত করেন তিনি।
এ দুটি জবানবন্দি পুলিশ মারধরের ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করা হয়েছে এবং তা বিধি মোতাবেক হয়নি দুই মামলায় আসামিপক্ষের দুই আইনজীবী এ অভিযোগ করায় আদালত জবানবন্দি গ্রহণকারী ওই বিচারকের (হারুন অর রশিদ) এর সাক্ষ্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বিজ্ঞাপন
রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ভার্চুয়ালী ওই বিচারকের সাক্ষ্য গ্রহণ করে ফরিদপুর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক মো. শিহাবুল ইসলাম।
বিচারক হরুন অর রশিদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটিতে পিএইচডি করার জন্য সেখানে অবস্থান করছেন। যে দুটি ডাকাতির মামলায় ওই বিচারক দুই আসামির জবাবন্দি নথিভুক্ত করেন। এর মধ্যে একটি নগরকান্দা এবং অপরটি মধুখালী থানার।
বিজ্ঞাপন
নগরকান্দা থানার মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, নগরকান্দার গজারিয়া বাজারে রামনগর ইউনিয়নের দেবী নগর গ্রামের বাসিন্দা গৌরাঙ্গ কুমার রায়ের (৩৯) একটি সোনার দোকান ছিল। ওই দোকানে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই দোকানে ডাকাতি হয়। ২০/২৫ জনের একটি ডাকাত দল দোকানের স্টিলের আলমালির তালা ভেঙে ৪ ভরি ৯ আনি সোনার অলঙ্কার, ৫০ ভরি রূপা এবং নগদ ২৬ হাজার টাকাসহ মোট ২ লাখ ২ হাজার ৭৫০ টাকাসহ মালামাল ডাকাতি করে। এ ঘটনায় পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি গৌরাঙ্গ কুমার রায় বাদী হয়ে অজ্ঞাত ২০/২৫ জনের নামে ডাকাতির অভিযোগে নগরকান্দা থানায় মামলা করেন।
এ মামলার আসামি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কাফুরিয়া গ্রামের মো. বাচ্চু মোল্লার (৪৪) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল রেকর্ড করেন বিচারক মো. হারুন অর রশীদ।
মধুখালী থানায় মামলার এজাহারসূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ৫ জুন দুপুর ১২টার দিকে পদ্মা তেল কোম্পানির এজেন্ট রাজবাড়ী সদরের খানখানাপুর এলাকার বাসিন্দা লাল মিয়া (৬৪) গোয়ালন্দ ফিলিং স্টেশন ২ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে যাওয়ার পথে ফরিদপুরের মধুখালীর উপজেলার কামারখালী সেতুর কাছে সাত সদস্যের একটি ডাকাত দল আরেকটি মাইক্রোবাস নিয়ে তার গাড়িটির গতিরোধ করে। ডাকাতদলের সদস্যরা লাল মিয়াকে গাড়ি থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে গাড়িতে থাকা টাকা ভর্তি ব্যাগ ডাকাতি করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ওইদিনই লাল মিয়া নিজে বাদী হয়ে মধুখালী থানায় একটি ডাকাতির মামলা করেন।
এ মামলার আসামি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার আড়কান্দি গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ মোল্লা (৪৬) গত ২০০৯ সালের ১৩ জুন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ জবানবন্দি নথিভুক্ত করে বিচারক মো. হারুন অর রশীদ।
দুই মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী নগরকান্দা মামলার মো. শাহজাহান মিয়া এবং মধুখালী থানার আইনজীবী মোজাম্মেল হোসেন পরবর্তীতে আদালতে ওই দুই আসামির দেওয়া জবানবন্দির বিষয়ে আপত্তি জানান। তারা আদালতকে বলেন, পুলিশ ওই দুই আসামিকে মারধরের ভয়ভীতি দেখিয়ে আদালতে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছেন। আইনজীবীরা দাবি করেন ওই দুটি ডাকাতির ঘটনায় জবানবন্দি প্রদানকারী ব্যক্তিদ্বয় আদৌও জড়িত নন।
বর্তমানে এ মামলা দুটি ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় মো. শিহাবুল ইসলামের আদালতে চলমান রয়েছে।
এই আদালতের বিচারক দুটি ডাকাতির মামলায় আসামিপক্ষের দুই আইনজীবীদের আভিযোগের প্রেক্ষিতে জবানবন্দি গ্রহণকারী বিচারকের সাক্ষ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে হারুন অর রশিদ বিদেশে থাকায় কিভাবে তার সাক্ষ্য নেওয়া যায় এ প্রক্রিয়ার জন্য আদালত আইন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন। আইন মন্ত্রণালয় থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে হারুন অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত হয় ভার্চুয়ালি সাক্ষ্য প্রদান করবেন ওই বিচারক।
এ প্রেক্ষাপটে রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ভার্চুয়ালি ওই বিচারকের সাক্ষ্য গ্রহণ করে ফরিদপুর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালত।
এ সময় হারুন অর রশিদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিচারক মো. শিহাবুল ইসলাম, আপত্তি প্রদানকারী দুই মামলার আসামিপক্ষের দুই আইনজীবী, রাষ্ট্রপক্ষের কৌশলী (পিপি) ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত রাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা।
ভর্চুয়ালি সাক্ষ্য নেওয়ার সময় আসামিপক্ষের দুই আইনজীবী তাদের আপত্তি তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী জবানবন্দি গ্রহণকারী বিচারক হারুন অর রশিদকে বলেন,আপনি স্বীকার করেন বা না করেন আমাদের আসামিকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে মারধরের ভয়ভীতি দেখিয়ে অসত্য তথ্য প্রদান করিয়েছে বা এ তথ্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং সত্য নয়, যা বিধিমোতাবেক হয়নি।
উত্তরে হারুন অর রশিদ জানান, প্রত্যেক আসামিকেই দুইজন কনস্টেবলসহ আমার কাছে আনা হয়। তাদের শরীরে দৃশ্যমান কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। মানিসকভাবে তারা বিমর্ষ ছিলেন বলে মনে হয়নি। তারা স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দি পড়িয়ে শুনিয়ে পরে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ওই আদালতের পিপি মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, হারুন অর রশিদ বর্তমানে পিএইডি করছেন। দেশে ফিরে এসে আদালতে সাক্ষ্য দিতে হলে আরও দুই থেকে তিন বছর সময় বেশি লাগতো। এতে মামলার দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হতো। এমনিতেই মামলা দুটির বয়স প্রায় ১৫ বছর হয়ে গেছে। এজন্য এ আদালতের উদ্যোগে আইন মন্ত্রণালয় ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে বিচারকের এ সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, দেশের কোনো মামলায় বিদেশ থেকে যুক্ত হয়ে বিচারকের সাক্ষী দেওয়ার ঘটনা দেশে এই প্রথম ঘটল। সেই হিসেবে ফরিদপুরের আদালত নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষি হলো।
প্রসঙ্গত, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশে প্রথমবারের মতো ২০২০ সালের ২৯ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আদালতগুলোতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর বিচার বিভাগকে সচল রাখার প্রয়োজনীয়তায় দেশে ভার্চুয়াল মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২০ সালের ১১ মে থেকে সীমিত পরিসরে বিচারিক কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে দেশে ভার্চুয়াল আদালত চালু হয়েছিল।
জহির হোসেন/এমএএস