দক্ষ ও জাতীয় মানের সাঁতারু তৈরি করার জন্য ২১ বছর আগে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের উদ্যোগে রাজবাড়ীতে নির্মিত হয় আন্তর্জাতিক মানের সুইমিংপুল। ২১ বছর বয়সের সুইমিংপুলটি চালু হবার পর দীর্ঘ ১৭ বছর ধরেই অযত্নে অবহেলায় বন্ধ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও নানা অব্যবস্থাপনায় ২০০৭ সালে উদ্বোধনের পর আর আলোর মুখ দেখেনি আন্তর্জাতিক মানের এই সুইমিংপুলটি।

দ্রুত সংস্কার করে সাঁতারে রাজবাড়ীর হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে সুইমিংপুলটি পুনরায় চালুর দাবি জানিয়েছেন জেলার ক্রীড়া প্রেমী ও সংশ্লিষ্টরা। 

জানা গেছে, জাতীয় মা‌নের সাঁতারু তৈ‌রির উদ্দেশ্যে সরকার ২০০৩ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তত্ত্বাবধানে রাজবাড়ী-কু‌ষ্টিয়া আঞ্চ‌লিক মহাসড়‌কের পাশে মুরগির ফার্ম এলাকার পুলিশ লাইন্সে ভবানীপু‌রে প্রায় ৩ একর জমির ওপর ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হয় জাতীয় মানের রাজবাড়ী সুইমিংপুল। নির্মাণের পর ওই বছরের মাঝামাঝিতে পুলটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। পরে একই বছরের শেষ দিকে ২০০৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম সুইমিংপুলটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।

উদ্বোধনের পর থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চালু ছিল সুইমিংপুলটি। পরবর্তী সময়ে এখানে কোনো লোকবল পদায়ন না করায় এবং গভীর নলকূপটি অকেজো হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় পুলটি। সুইমিং পুলটির বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি এখন অকেজো। আয়রন ওয়াটার ফিল্টার মেশিন, গভীর নলকূপ, অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বেশিরভাগই নষ্ট। বকেয়া রয়েছে ১০ বছরের বেশি বিদ্যুৎ বিল। বাকি পরেছে কয়েক বছরের ভূমি উন্নয়নের কর। সীমানা প্রাচীর অরক্ষিত হওয়ায় চুরি গেছে সুইমিং পুলের মূল্যবান যন্ত্রপাতিও। 

এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে জেলা পরিষদসহ স্থানীয়ভাবে অর্থের সংস্থান করে কয়েক দফায় পুলটি চালু করা হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অপরদিকে ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ক্রীড়া) আব্দুল করিম (এনডিসি) সুইমিংপুলের বিদ্যমান অবস্থা পরিদর্শন করে সুইমিংপুলটি চালুর ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও তাতে কাজ হয়নি। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেহাল অবস্থায় রয়েছে এটি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে অবস্থিত একমাত্র সুইমিংপুলের প্রধান গেট তালাবদ্ধ।দীর্ঘদিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না করায় গেটের সামনে ময়লার স্তুপ ও আগাছা দিয়ে ভরে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকায় গেটটি জং ধরে রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মূল ফটকের ছোট পকেট গেটের তালা খুলে সুইমিংপুলের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল বিশাল একটি মাঠ। মাঠের পাশেই সুইমিংপুল। ময়লা আবর্জনার স্তুপ, আগাছা ও ঝোপ জঙ্গলে সুইমিংপুলের পুরো মাঠ ছেয়ে গেছে। মাঠের মধ্যে বিচরণ করছে গরু। ঘা‌সের কার‌ণে সুইমিংপুলে যাওয়ার ইটের রাস্তা‌র অবস্থানও বোঝার উপায় নেই। একটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল নাইট গার্ডের।

সুইমিংপুলের ভেতরে ঢোকার কেচি গেট তালাবদ্ধ। এরপর নাইট গার্ডের মাধ্যমে তালা খুলে সুইমিং পুলের ভেতরে উঠে দেখা গেল সুইমিংপুলের মধ্যে পানি নেই। পুলের ভেতরে ময়লার স্তর পড়ে গেছে। পুলে পানি না থাকায় শুকিয়ে চৌবাচ্চাটা চৌচির হয়ে গেছে।বেশকিছু জায়গা থে‌কে উ‌ঠে গে‌ছে টাইলস, আয়র‌নে কা‌লো ও হলুদ বর্ণ ধারণ ক‌রে‌ছে বাকি টাইলসগুলো। ব্যবহার না হওয়ায় সুইমিংপুলে ওঠার পা‌শের দুইটি সিঁড়ি‌তে জ‌ন্মে‌ছে আগাছা, ঝোপজঙ্গলের কারণে সিঁড়িগুলোও ঢেকে গেছে। ব্যবহার না হওয়ায় সুইমিংপুলের ভেতরে ড্রেসিং রুমের অবস্থাও নাজুক। মাকড়সার জাল ও ধুলাবালিতে ড্রেসিং রুম ছেয়ে গেছে। ড্রেসিং রুমের ওয়াশরুম ও বাথরুম ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন সুইমিংপুলটি সংস্কার না করায় বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। বিদ্যুতের বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ বিছিন্ন রয়েছে। পাশেই সুইমিংপুলের প্রধান পাম্পের ঘরটি তালাবদ্ধ। সেখানেও আগাছা ও ঝোপে ছেয়ে গেছে। পা‌নি নিষ্কাশ‌নের ড্রেনে‌জ ব্যবস্থা থাক‌লেও ড্রেনগুলো ময়লার স্তুপে ভরে গেছে।

মা‌ঝে-ম‌ধ্যে প্রশিক্ষণ ও প্রতি‌যো‌গিতার আ‌য়োজ‌নে পা‌নি উত্তোল‌নের জন্য কমপ্লে‌ক্সের ডান পা‌শে বসা‌নো হ‌য়ে‌ছে স্যালো মে‌শি‌ন।

সাগর নামের তরুণ এক সাঁতারু ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজবাড়ীর সুইমিংপুলে কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। সুইমিংপুলে পানি থাকে না, ভালো প্রশিক্ষক নেই, অন্যান্য আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। যে কারণে ঢাকা থেকে জাতীয় ক্যাম্প করে আসার পরে রাজবাড়ী সুইমিংপুল থেকে সাঁতার শেখার কোনো সুযোগ সুবিধা পাইনি। রাজবাড়ীর সুইমিংপুলটি আবার চালু হলে আমরা সাঁতার শিখতে পারব। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারব।

রাজবাড়ীর গণমাধ্যম কর্মী দেবাশীষ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, অব্যবস্থাপনার কারণেই রাজবাড়ীর সুইমিংপুলটি মৃত প্রায়।দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় এখানের টাইলসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। চৌবাচ্চায় পানি নেই। সুইমিংপুলটি যদি আর কয়েক বছর এভাবে পড়ে থাকে তাহলে এটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই দ্রুত এর সংস্কার করা দরকার বলে আমি মনে করি।

রাজবাড়ীর স্থানীয় বাসিন্দা সুজন বিষ্ণু ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে আমাদের আশপাশে অধিকাংশ পুকুর, খাল, বিল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে শিশুরা, বাচ্চারা সাঁতার শিখতে পারছে না। আবার বয়স্করাও অনেকে আগ্রহ করে সাঁতার শিখতে চায় তারাও আশেপাশে পুকুর না থাকায় সেটাও পারছে না। সুইমিংপুলটির অবস্থা বর্তমানে খুবই নাজুক ও নাজেহাল। এটি যদি সংস্কার করে পুনরায় চালু করা হতো তাহলে সবার জন্যই ভালো হতো।

রাজবাড়ী স্টেডিয়ামের ক্রীড়া প্রশিক্ষক হাজী স্যার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা উদ্যোগ নিলে সুইমিংপুলটি আবার চালু করা সম্ভব। কারণ এখানে সুইমিংপুল রয়েছে। শুধু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটি বন্ধ রয়েছে। আমরা চাই সুইমিংপুলটি আবার চালু করা হোক।

রাজবাড়ী সুইমিং পুলের নাইট গার্ড আক্কাস আলী মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সময় রাজবাড়ীর সুইমিংপুলে অনেক ভালো খেলোয়াড় ছিল। ভালো সাঁতারু ছিল। বর্তমানে আমাদের পানির সমস্যা, পানিতে আয়রন,পা নি তোলার মেইন মোটরটাও নষ্ট পড়ে আছে। এগুলো ঠিক করতে অনেক টাকা পয়সার প্রয়োজন। সরকার যদি এই সুইমিংপুলটা সংস্কার করে আবার চালু করতো তাহলে আমাদের রাজবাড়ীর ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলায়, সাঁতারে উন্নতি করতে পারতো।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম সফি মোবাইল ফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে নানাবিধ সংস্কারের মাধ্যমে সুইমিং পুলটি চালু করা সম্ভব। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো সাড়া পাচ্ছি না। তাছাড়া স্থানীয়ভাবে এটি চালু করা সম্ভব না, কারণ ১০ বছরের বেশি বিদ্যুৎ বিল, কয়েক বছরের পৌর কর বাকি রয়েছে।ক্রীড়া মন্ত্রণালায় থেকে বরাদ্দ না পেলে এটি চালু করা সম্ভব না। 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি আবু কায়সার খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা জানি রাজবাড়ীতে একটি সুইমিংপুল রয়েছে। কিন্তু কিছু জটিলতা থাকার কারণে সুইমিংপুলটি সবসময় চালু রাখা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি সমস্যাগুলো উত্তরণের জন্য। 

এ বিষয়ে রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাজী কেরামত আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপনারা জানেন সরকার বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। তাই আমরা এই ব্যাপারে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি। বছরে তারা যদি কিছু অঙ্কের টাকা দিতো ও আর আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যারা আছি সবাই মিলে যৌথভাবে উদ্যোগ নিলেই এটা চালু রাখা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

উল্লেখ্য, সাঁতারে রাজবাড়ী জেলার রয়েছে গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস। জাতীয় পর্যায়ে সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেন রাজবাড়ীর ডলি আক্তার মুন্নী, লায়লা নুর, মিতা নুর, রুপালী আক্তার, শের আলী শরিফ, সোনালী আক্তার, পুতুল ঘোষ, নিবেদিতা দাসসহ অনেকেই। এদের মধ্যে অন্তার্জাতিক পর্যায়ের সাঁতার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হ‌য়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন ডলি আক্তার ও পুতুল ঘোষসহ আরও ক‌য়েকজন।

মীর সামসুজ্জামান/আরকে