পিরোজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, নিজেরা পাসপোর্টের আবেদন করলে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। কিন্তু দালালের শরণাপন্ন হলেই সব কাজ দ্রুত হয়ে যায়, লাগে না পুলিশ ভেরিফিকেশনও। এ জন্য অবশ্য গুনতে হয় অতিরিক্ত তিন থেকে চার হাজার টাকা। আবার কখনো দায়িত্বরত আনসার সদস্যরাও সেবাপ্রার্থীদের পাঠিয়ে দেন দালালদের কাছে।

জানা যায়, পিরোজপুর জেলা সদরের বাইপাস সড়ক এলাকায় গত বছরের ১২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় পিরোজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের। এর আগে জেলা শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি ভবনে চলত পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম। তখন থেকেই পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতি ও দালালের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ ছিল। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ পিরোজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালিয়ে তিনজন দালালকে আটক করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পিরোজপুর জেলা শাখা। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কফিল উদ্দিন মাহমুদ ওই তিন দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।

সম্প্রতি কয়েক দিন পিরোজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ঘুরে দেখা যায়, তেমন ভিড় না থাকলেও দালালদের দৌরাত্ম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। পিরোজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনের সড়কের অপর পাশে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নামের একটি ভবনে গড়ে উঠেছে একাধিক কম্পিউটারের দোকান, যেখানে বসে কাজ করেন দালাল ও তাদের সহযোগীরা। অথচ পাসপোর্ট অফিস হওয়ার আগে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ওই ভবনে কোনো ধরনের দোকানই ছিল না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন দালালকে টাকা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়ার পর গ্রাহকের আর ভোগান্তিই থাকছে না। প্রতিটি গ্রাহকের ফাইল প্রস্তুত করা, জমা দেওয়া এবং পুলিশি যাচাই-বাছাই শেষে গ্রাহকের হাতে পাসপোর্ট তুলে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সব কাজই দালাল করে দিচ্ছেন।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সীমা আক্তার। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে চান তিনি। এজন্য পাসপোর্টের আবেদন করতে পিরোজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান,  প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে খুব সকালে অফিসে এসে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। দুপুর দেড়টার দিকে জানতে পারেন জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে আনলেও তাকে তার সংশ্লিষ্ট নির্বাচন অফিস থেকে আনতে হবে জাতীয় পরিচয়পত্রের ভেরিফায়েড কপি। সীমা আক্তারের অভিযোগ, তার কাছে যে কাগজপত্র আছে এমন একই কাগজপত্র দিয়ে তার লাইনের সামনের এক ব্যক্তি পাসপোর্টের আবেদন জমা দিয়েছেন। সীমার দাবি, দালালদের টাকা দিলে এমন সমস্যা কোনো ব্যাপারই না।

পিরোজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে মো. মামুন নামের একজন জানান তার সব কাজ করা হয়ে গেছে। কাউকে অতিরিক্ত কোনো টাকা দিতে হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেল্লাল নামে আমার এক চাচা আছেন। তিনি বিদেশে লোক পাঠান। তার সঙ্গে অফিসে পরিচয় আছে। তাকে এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়েছি। তিনি সেই টাকা অফিসে দিয়েছেন আর আমি পাঁচ হাজার ৭৫০ টাকা ব্যাংক ড্রাফট করেছি। আর কোনো টাকা লাগেনি, সমস্যাও হয়নি।

পাসপোর্ট অফিসের সিটিজেন চার্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ পৃষ্ঠার পাঁচ বছর মেয়াদি নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে এক থেকে তিন দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার দশ বছর মেয়াদি নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট এক থেকে তিন দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফিই গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে এক নারীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ছেলের জন্য পাসপোর্ট করতে তিনি তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত দিয়েছেন। সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে পাসপোর্ট না পাওয়ার ভয়ে তিনি তার কথা অস্বীকার করেন। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে এসে পাসপোর্ট করার কথা জানতে চাইলে গেটে থাকা এক আনসার সদস্য আমাদেরকে সামনের কম্পিউটার দোকানে যেতে বলেন। সেখান থেকে তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত দিয়ে ঝামেলা ছাড়াই কাজ করা গেছে।

পরিচয় গোপন রেখে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার কাওসার নামের এক দালালের কাছে ১০ বছরের জন্য নতুন পাসপোর্ট করতে কী কী লাগবে জানতে চাইলে কাওসার বলেন, আপনার ও বাবা-মায়ের পরিচয়পত্র আর একটি বিদ্যুৎ বিলের কপি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে নুহ মিয়ার কাছে গেলেই হবে। টাকা লাগবে ১০ হাজার, পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব কাজ আমরাই করবো। আজকেও একটা পাসপোর্ট করে দিয়েছি।

এ বিষয়ে অনলাইন কম্পিউটারের নুহ মিয়ার কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তো এসব কাজই করি। কাগজপত্র নিয়ে আসেন, কাজ হয়ে যাবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনও আমরা করে দেব।

কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব কথা ফোনে বলা যাবে না। আপনি হোয়াটসঅ্যাপে বইলেন। ফোনে বললে আপনিও সমস্যায় পড়বেন, সঙ্গে আমিও।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পিরোজপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক কল্লোল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জানি না কারা অভিযোগ করেছে। আপনি যদি আমাদের রেকর্ড দেখেন তাহলে সেখানে দেখবেন এখানে সেবা নিতে ভিআইপি হোক কিংবা একজন সাধারণ মানুষ সবাইকে আমরা একই সেবা দিচ্ছি। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে সেটা যেদিন আবেদন করে সেদিনই গ্রহণ করা হয়। আবেদনে ভুল থাকলে তাও ঠিক করে দেওয়া যায়। তবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলে সেবাপ্রার্থীকে তা নিয়ে আসতে বলা হয়।

তিনি আরও বলেন, যারা কাউন্টারে থাকে তাদেরকে আমি বলে দিয়েছি আমার কনসার্ন ছাড়া যেন কেউ ফিরে না যায়, আর কেউ ফিরে যাচ্ছেও না। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে গ্রাহক ভোগান্তি নেই।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে টাকা নেওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে পিরোজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। যদি কোনো দালাল কিংবা পুলিশ সদস্য এ কাজে জড়িত থাকে তাহলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সার্বিক বিষয়ে পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মো. জাহেদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সমন্বয় সভায় এ বিষয়ে সব সময় আলোচনা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ একটি টিম এ বিষয়ে খোঁজ রাখছে। এ ছাড়া আমি লোক পাঠিয়েও খবর নিই। তারপরও যেহেতু অভিযোগ এসেছে আমি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে এ বিষয়ে খোঁজ নেব।

এমজেইউ