ভারত, ভুটান ও নেপাল কাছাকাছি হওয়ায় লালমনিরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই কমবেশি বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা থাকে। তবে সেবা নিতে আসা লোকজনের অভিযোগ, তাদেরকে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি দালালচক্র। আর এই চক্রের কারণে পাসপোর্ট অফিসে যে ভিড় ছিল, সেটি এখন অনেকটাই কমে গেছে। সিন্ডিকেটের বাইরে কর্মকর্তারাও কিছু করেন না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

এসব অভিযোগের বিষয়ে পরিচয় গোপন করে সম্প্রতি অনুসন্ধানে নামে ঢাকা পোস্টের জেলা প্রতিনিধি। অটোরিকশা থেকেই নামতেই পাসপোর্ট অফিসের পাশে থাকা কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানের মালিক মানিক সরকার ডাকাডাকি শুরু করেন। একপর্যায়ে এই প্রতিবেদক দ্রুত পাসপোর্ট করার উপায় জানতে চাইলে সহজ রাস্তা দেখিয়ে দেন তিনি।

পাসপোর্ট অফিসে দীর্ঘ কয়েক দিনের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের সামনে থাকা কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানের মালিকরাসহ পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন কর্মচারী দালালচক্রের মূল সদস্য। তারাই এই জেলার সহজ-সরল মানুষকে জিম্মি করে ঘুষ বাণিজ্য করে আসছেন। তারা কর্মকর্তাদের কাছে নিয়ে যান। সেখানে কিছুক্ষণ কাগজপত্র দেখে ভুল ধরিয়ে দেন কর্মকর্তারা। যদিও টাকা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই ভুল ঠিক করে দেন কর্মকর্তারা। এজন্য পাশের একটি গোপন কক্ষ রেখেছেন তারা। আর ওই গোপন কক্ষ যদি সেবাগ্রহীতারা না যান তাহলে কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে দালালচক্রের কাছে পড়তেই হবে।

লালমনিরহাট পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী পলাশ

লালমনিরহাট পাসপোর্ট অফিসের দালালচক্রের অন্যতম সদস্য পলাশ। তিনি ওই পাসপোর্ট অফিসে ছবি তোলার দায়িত্বে রয়েছেন। পলাশ ছাড়াও কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন পাসপোর্ট অফিসে ঘোরাফেরা করেন। পাসপোর্ট করতে আসা সেবাগ্রহীতাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে পাঠিয়ে দেন দালালচক্রের কাছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের সাপ্টিবাড়ি বাজারের পাশেই লালমনিরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। এখানে প্রতিদিনই শতাধিক সেবাপ্রত্যাশী আসেন। পাসপোর্ট অফিসের সামনে গড়ে উঠা কম্পিউটার দোকানগুলোতে গেলেই কাগজপত্র ঠিক করে দেওয়ার চুক্তি করেন দালালচক্র। সেখানেই মূলত পাসপোর্টের সকল সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার দরদাম চলে। আর এসবের মূল হোতা পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহায়ক পলাশসহ অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

জানা গেছে, ওই এলাকার পঞ্চাশের অধিক দালালকে নিয়ন্ত্রণ করেন পলাশ। এ ছাড়া পলাশের আত্মীয়-স্বজনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাসপোর্ট অফিসের পাশে। পাসপোর্ট অফিসে গেলে সেবাপ্রত্যাশীদের ফেরত পাঠান দোকানদারদের কাছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিস সহায়ক পলাশ বেরিয়ে এসে দোকানেই দরদাম শুরু করেন। প্রত্যেক পাসপোর্ট থেকে ১২০০ টাকা নেওয়া হয়। আর পাসপোর্টে বড় ধরনের কোনো ভুল থাকলে প্রত্যেক পাসপোর্ট থেকে ১৮০০ টাকা নিয়ে থাকেন। পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্য থেকে শুরু করে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এই ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, প্রতি পাসপোর্টে ২০০ টাকা পান দালালরা। আর পলাশের মাধ্যমে বাকি টাকা চলে যায় পাসপোর্ট অফিসে।

পাসপোর্ট করতে আসা মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারতে চিকিৎসার জন্য পাসপোর্টের আবেদন করেছি। ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার পর কর্মকর্তা ভুল ধরে। পরে সংশোধনের জন্য অতিরিক্ত টাকা দাবি করে। সেই টাকা দেওয়ার পর ছবি তুলে রশিদ জমা দিয়েছি।

কালীগঞ্জ থেকে আসা আরেক পাসপোর্টপ্রত্যাশী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাকে নিয়ে পাসপোর্ট করতে এসেছিলাম। অসুস্থ মাকে দিয়ে সারাদিন পাসপোর্ট অফিসেই ছিলাম। পরে পলাশের কাছে ১২০০ টাকা দেওয়ার পর দ্রুত তিনি ছবি তুলে নিয়েছেন। এই টাকা নাকি শুধু তিনি একা নেন না। একাধিক কর্মকর্তা ও একটি সিন্ডিকেটের হাতে যায়। দ্রুত এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রশাসনের দৃষ্টি প্রার্থনা করছি।

পুলিশ ভেরিফিকেশনেও টাকা

টাকা ছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশন হয় না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যক্তি। প্রত্যেক পাসপোর্টপ্রত্যাশীকে পুলিশকে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা হলেও দিতে হয়। অনেক সময় এর বেশিও দিতে হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জুয়েল মিয়া নামের এক ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভেরিফিকেশন করার পর পুলিশ সদস্যকে খুশি করতে টাকা দিতে হয়। না হলে ভেরিফিকেশনের নামে অনেক সময় বিলম্ব করেন। এতে পাসপোর্ট পেতে আমাদের দেরি হয়ে যায়। সে কারণে অনেক সময় বাধ্য হয়েই পুলিশ সদস্যকে ভেরিফিকেশনের জন্য একপ্রকার ঘুষ দিতে হয়।

পাসপোর্ট করতে গ্রামের অসহায় মানুষদের ভোগান্তির সীমা নেই বলে অভিযোগ করেন এই ব্যক্তি।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কম্পিউটার দোকানদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের নির্দেশেই পলাশ এসব কাজ করেন। তাছাড়া মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করেই সব কাগজপত্র ঠিক করে টাকা নেন পলাশ। এতে আমি তার কোনো দোষ দেখছি না। আর শুধু লালমনিরহাট নয় সব স্থানেই এ ধরনের সিন্ডিকেট রয়েছে।

এসব বিষয়ে পলাশের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, আমি কোনো ঘুষ নিই না। এই এলাকার সকল সাংবাদিকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তারা আমাকে জানেন এবং চেনেন।  আমি কাউকে জিম্মি করে টাকা নিই না। এর প্রমাণ দিতে পারলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব। তবে অনেকে খুশি হয়ে মিষ্টি খাওয়ার জন্য আমাকে টাকা দেন। এতে আমি দোষের কিছু দেখছি না।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে লালমনিরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আইয়ুব আলীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বিশ্বাস এই অফিসে কোনো ঘুষ বাণিজ্য হয় না। তবে অফিসের বাইরে যদি কেউ টাকা দিয়ে থাকে তবে অফিসের কোনো কর্মকর্তা সেই দায় নেবে না।

ঘুষের টাকা সব কর্মকর্তার পকেটে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে মো. আইয়ুব আলী বলেন, যদি এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ থাকে অবশ্যই আমাকে দিতে হবে। ‌এসব না দিলে আমি ফোনে কথা বলতে চাই না। অফিসে আসেন, চা খেয়ে কথা হবে বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিস নিয়ে আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ দেয়নি। যদি কোনো অভিযোগ পাই তবে অবশ্যই ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আমরা চাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে। ‌

এমজেইউ