চুয়াডাঙ্গার গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র বদলে যাচ্ছে ব্ল্যাক বেঙ্গল (কালো জাতের) ছাগল পালনে। বিশ্বখ্যাত এই ছাগল পালন করে এখানকার কৃষি পরিবারগুলোতে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। প্রায় সব বাড়ির উঠানেই দেখা মেলে এই জাতের ছাগল। অনেক বাড়িতে আলাদা ঘর করে মাচায় ছাগল পালন করতে দেখা যায়।

গ্রামীণ জনপদের প্রায় পরিবার কালো ছাগলের ছোট-বড় খামার করে আজ স্বাবলম্বী। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে বাড়তি তেমন খরচ না থাকায় খুব সহজেই এর দেখভাল করতে পারেন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও।

চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলা ঘুরে মূল সড়ক পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাট ও মেঠো পথেও দেখা যায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। কোথাও উঠানে, কোথাও-বা বাড়ির মাচায় চলছে ছাগল লালন-পালন। একটি মা ছাগল বছরে দুবারে ৩ থেকে ৪টি বাচ্চা দেয়। অনেক খামারি ২০ থেকে ৩০টি ছাগল পালন করে বছরে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করেন। এতে অনেকেরই পাল্টে গেছে জীবনযাত্রা।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাড়াও চুয়াডাঙ্গায় চোখে পড়ে তোতামুখী, হরিয়ানা, যমুনাপাড়ি ও বিটল জাতের ছাগল। তবে এর মধ্যে ৭০ ভাগই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল। এই অঞ্চলের বেকার তরুণ-তরুণী, যুবক ও নতুন উদ্যোক্তা এবং দরিদ্র কৃষকরা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি পুষ্টি সরবরাহের কাজেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ছাগল উৎপাদন হয়ে থাকে। এর থেকে প্রাই ২৩ হাজার মেট্রিক টন মাংস উৎপাদিত হয়। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ছাগলের মাংসের দাম প্রকারভেদে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। জেলায় ছাগলের মাংস ও চামড়া বিক্রি করে বছরে আয় হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ছাগলের চামড়া বিক্রি করেও মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়ে থাকে। ফলে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটছে এ জেলার মানুষের। এ ছাড়া ছাগল উন্নয়ন খামার থাকায় সহজে উন্নত জাতের ছাগি ও পাঁঠা সংগ্রহ করা যায় সহজে। এতে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের প্রজনন বৃদ্ধি করতে পারছেন।
 
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জাতের ছাগলের রোগব্যাধি বলতে শীতকালে ঠান্ডাজনিত রোগ ছাড়া তেমন কোনো রোগবালাই হয় না। যদি রোগ হয়, প্রাণিসম্পদ দফতরের প্রশিক্ষিত চিকিৎসক রয়েছেন। তারা সার্বিক সহযোগিতা করে থাকেন।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রাণিবিদ্যাবিষয়ক স্বীকৃত জার্নালগুলোতে ব্ল্যাক বেঙ্গল নিয়ে শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই গবেষণার মাঝ পর্যায়ে ২০০৭ সালের ২০ মার্চ জাতিসংঘের সংবাদ সংস্থা ইউএন নিউজে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। কিন্তু এখানেই রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাণিসম্পদ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বসতি। ওই বছরই আইএইএর ওয়েবসাইটে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বিশ্বসেরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এই ছাগলের নবজাতকের মৃত্যুহার কম। আর এরা বছরে দুবারে কমপক্ষে চারটি বাচ্চা দেয়। তাই অন্য জাতগুলোর তুলনায় এই জাতের ছাগলের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, এটি পালন করতে বড় চারণভূমি লাগে না। বাড়ির উঠানেই এরা দিব্যি বেড়ে ওঠে। তবে এফএওর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দুর্বল দিক এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-ওজন এবং দুধের পরিমাণ অন্যান্য ছাগলের চেয়ে কম। আফ্রিকার মাসাই, ভারতের যমুনাপাড়ি ও চীনা জাতের ছাগলের মাংস ও দুধের পরিমাণ ব্ল্যাক বেঙ্গলের চেয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি।

তবে ওই তিন জাতের ছাগলের ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাচ্চা জন্মের পরই মারা যায়। সে ক্ষেত্রে ব্ল্যাক বেঙ্গলের বাচ্চার মৃত্যুর হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এ কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গলের জীবনচক্রে মোট বংশবৃদ্ধির হার অনেক বেশি। তাই বিজ্ঞানীরা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার বিচারে এটিকে সেরা জাত হিসেবে নির্বাচন করেছেন।

পৃথিবীতে এই মুহূর্তে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপায়ে মডিফায়েড মিলে প্রায় ৩০০-এর মতো জাতের ছাগল আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের কালো ছাগল বা ব্ল্যাক বেঙ্গলকে অন্যতম সেরা জাত বলা হয়। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলায় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়।

জেলার এই ঐতিহ্যবাহী ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সংরক্ষণে চুয়াডাঙ্গা তথা দেশের বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েভ ফাউন্ডেশন দামুড়হুদা উপজেলার কোষাঘাটায় ৩৫ বিঘা জমির ওপর একটি মিশ্র খামারে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সংরক্ষণে আধুনিক পদ্ধতিতে ছাগি ও পাঁঠার উৎপাদনসহ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছে এবং ছাগল পালনের ওপর এলাকার ও দেশের আগ্রহী যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রেখেছে।

এ বিষয়ে কথা হয় বেসরকারি এনজিও ওয়েব ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক জহির রাইহানের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বিশ্বখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল চুয়াডাঙ্গার এক স্বনামধন্য ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের সমাদর শুধু দেশেই না, পৃথিবীজুড়ে চুয়াডাঙ্গার কালো ছাগলের চাহিদা রয়েছে। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি ওয়েভ ফাউন্ডেশনও এর বংশবৃদ্ধিতে কাজ করছে। আমি মনে করি, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল চুয়াডাঙ্গার একটি সম্পদ। এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকার সঙ্গে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

তিনি বলেন, জেলায় কমবেশি প্রায় সব বাড়িতেই এই ছাগল পালন করে থাকে। এটাকে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পালনে যদি সহযোগিতা করা যায়, তাহলে এ অঞ্চলের মানুষ আরও বেশি স্বাবলম্বী ও সমৃদ্ধ হতে পারবে।

ওয়েভ ফাউন্ডেশন থেকে ঋণ নিয়ে দুটি ছাগল কিনে যাত্রা শুরু করেছিলেন চুয়াডাঙ্গা শহরের গুলশানপাড়ার ব্যবসায়ী মাহমুদুন্নবী। ছয় বছরের ব্যবধানে তার খামারে এখন ৬০টি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। এখন তার সংসারে এসেছে সচ্ছলতা। তার মতো হাজারো পরিবার আছে, যাদের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে এই জাতের ছাগল লালন-পালন করে।

মাহমুদুন্নবী বলেন, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে প্রতিবছর তার মোটা অঙ্কের টাকা আয় হয়। শখের বশে প্রথমে দুইটা ছাগল দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার ৬০টি ছাগল আছে। তিনি আরও বলেন, বেকার যুবকরা ইচ্ছা করলে বাড়িতে অতি সহজেই ক্ষুদ্র পরিসরে ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী হতে পারে। ব্ল্যাক বেঙ্গলের তেমন কোনো রোগবালাই নেই বললেই চলে। আমরা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে অনেক সহযোগিতা পাই। ফোন করলেই চলে আসেন চিকিৎসক।

চুয়াডাঙ্গা শহরের বনানীপাড়ার শাহাবুদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির উঠানে এক পাল ছাগলকে খাওয়াচ্ছেন তিনি। উঠানে মাচায় ৫০টি ছাগল রয়েছে। তিনি জানান, তিনি মাত্র দুটি ছাগল নিয়ে শুরু করেছিলেন। এই ছাগল বছরে তিন থেকে চারটা করে বাচ্চা দেয়। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এদের থেকে আট-দশ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। এরা বাড়ির আশপাশের গাছের পাতা, সবজির বর্জ্য, ঘাট ও বিচুলি খেয়েই বড় হয়। তাই এদের পালতে বাড়তি কোনো চাপও পড়ে না।

আলমডাঙ্গা উপজেলায় নাগদহ গ্রামের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। পড়াশোনার পাশাপাশি পাঁচ বছর ধরে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালন করে আসছি। এখন আমি স্বাবলম্বী। ছাগল বিক্রি করে বছরে অনেক টাকা আয় করছি। বেকারত্ব ঘুছিয়েছি। সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। আরও সুযোগ-সুবিধা পেলে আমরা বাণিজ্যিকভাবে ছাগল পালন করতে পারব।

বেকার যুবক ও তরুণ উদ্যোক্তা পড়াশোনার পাশাপাশি এই ছাগল পালন করতে পারেন। অল্প সময়ের মধ্যে ভালো আয়ের সুযোগ হতে পারে এই জাতের ছাগল, এমনটাই পরামর্শ আবদুল্লাহর।

চুয়াডাঙ্গা ছাগল উন্নয়ন খামারের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলার বিশ্ববিখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সংরক্ষণে ১৯৯৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় ছাগল উন্নয়ন খামার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর এ খামার থেকে খুলনা বিভাগের ১০টি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্ধারিত মূল্যে পাঁঠা-ছাগি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। প্রতিটি পাঁঠা ১ হাজার ২০০ টাকা ও ছাগির মূল্য নেওয়া হয় ১ হাজার ৮০০ টাকা। এ খামারে পাঁঠা-ছাগি মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ছাগল পালন করা হয়। ফলে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তিনি বলেন, কালো জাতের ছাগল পৃথিবীর সেরা একটি জাত। আর এই জাতের ছাগলের উৎস চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর ও যশোরের কিছু আংশিক এলাকায়। তবে চুয়াডাঙ্গায় এই কালো জাতের ছাগলের প্রাধান্য বেশি। এই খামার প্রতিষ্ঠার মূল কারণ হলো কালো জাতের ছাগি ও পাঁঠা সংরক্ষণ করা।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গোলাম মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জন্য চুয়াডাঙ্গা একটি অভয়াশ্রম। এখানকার জলবায়ুর ও পারিপার্শ্বিকতা ভালো ও উষ্ণ অনুকূল আবহাওয়া হওয়ায় ছাগল পালনের ক্ষেত্রে এটা সব থেকে উপযোগী এলাকা। এই জাত হলো চুয়াডাঙ্গার ব্র্যান্ড।

তিনি বলেন, বিশ্বের মধ্যে ১০০টি ছাগল গবেষণা করে দেখা গেছে, এই কালো জাতের ছাগলই সর্বশ্রেষ্ঠ। জেলার প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করা ও আমিষের চাহিদা পূরণ করতে ব্ল্যাক বেঙ্গল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তা ছাড়া দারিদ্র্য দূর করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। সবচেয়ে সুবিধা হলো শীতকালে ঠান্ডাজনিত রোগ ছাড়া তেমন কোনো রোগবালাই হয় না এই জাতের ছাগলের।

এনএ