ফেনীতে বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টেই নেই অগ্নিনির্বাপক, অপ্রতুল পানি
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নকশাবহির্ভূত স্থাপনা, যত্রতত্র হোটেল-রেস্তোরাঁ, জলাধার ভরাটসহ নানা কারণে প্রবল অগ্নি ঝুঁকির মুখে দেশের অন্যতম জেলাশহর ফেনী। শহরে গড়ে উঠা ঘিঞ্জির মতো মার্কেটগুলো বেশিরভাগই নকশাবহির্ভূত। নেই আগুন নেভানোর ব্যবস্থা। ঘুপচি গলির ভেতর শত শত দোকানের ক্রেতা বিক্রেতারা সবসময় থাকেন আতঙ্কে। চোখ ধাঁধানো ইন্টেরিয়রে রেস্টুরেন্টগুলো পরিণত হচ্ছে গ্যাস চেম্বারে। ফলে আগুন বা অন্য কোনো বিপদে বাড়ছে প্রাণহানির শঙ্কা।
ফেনী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, শহরে নিয়মিত বহুতল ভবন গড়ে উঠলেও মানা হচ্ছে না যথাযথ নীতিমালা। ভবনগুলোতে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও। এমন ২১টি ভবন অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। তবে এসব ভবনের তালিকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শহরের নবী হোটেল, সৌদি আল ফাহাম, তাকওয়া রেস্টুরেন্ট, ট্রাংক রোডের জালালিয়া সুইটস, আপ্যায়ন আফরোজ টাওয়ারের একাধিক রেস্টুরেন্ট, ডাক্তারপাড়ার চিলিস রেস্টুরেন্টসহ হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর সরু সিঁড়ি। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে গ্যাস সিলিন্ডার। এতে বাড়ছে অগ্নি ঝুঁকি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনী বড় বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিউমার্কেটের জায়গায় যে পুকুরটি ছিল যেকোনো প্রয়োজনে সেখানের পানি ব্যবহার করা যেত। পুকুরটি অগ্নি দুর্ঘটনায় বড় ভরসা ছিল। কিন্তু এটি ভরাটের পরে গত কয়েক বছরে আমরা সারাক্ষণ সহায়সম্বল হারানোর ভয়ে থাকি।
বিজ্ঞাপন
শহরের পৌর হকার্স মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, কয়েক মাস আগেও পাশের দোকানে আগুন লাগে। আমি নিজে সচেতন হলেও পাশের দোকানিরা এসব এড়িয়ে চলে। সবসময় চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়। এখানে কোনোভাবে একবার দুর্ঘটনা ঘটলে অনেক বড় ক্ষতি হবে।
ফেনী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবদুল মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেনী শহরে যেভাবে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে সেইভাবে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জানমাল রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। বড় বাজারের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে কোথাও পানি নেই। রাস্তাগুলো অনেক সরু। ভবনগুলো থেকে একসঙ্গে দুয়েকজন নামতে কষ্ট হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা পানির উৎস নেই বললেই চলে।
ফেনী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবুল বাসার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আধুনিক জেলার মধ্যে ফেনী অন্যতম। তবে এখানের অধিকাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। এজন্য প্রতিনিয়ত আমাদের কাজ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেশিরভাগ সময়েই উৎসুক জনতা আমাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আগুনের ঘটনা ঘটলেই মানুষজন মোবাইল নিয়ে ভিডিও করা শুরু করে। এতে আমাদের কাজের সমস্যা হয়। তারপরও আমরা নিয়মিত বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
ফেনী বড় বাজারে প্রবল অগ্নি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে উপসহকারী পরিচালক বলেন, বড় বাজারে একসময় একটি পুকুর ছিল। পরবর্তীতে সেটি ভরাট করে মার্কেট করা হয়েছে। এ বাজারে কোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পানির উৎস নেই। এ বিষয়ে বিভিন্ন সভায় পৌরসভা ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বসে আলোচনা হয়েছে। তারা পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। যতদিন করে না দেবে ততদিন বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হবে।
ফেনী শহর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পারভেজুল ইসলাম হাজারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় বাজারে ছোটবড় মিলিয়ে ৬ থেকে ৭ হাজার দোকান রয়েছে। এখানের সব দোকানই অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে পৌরসভার পক্ষ থেকে দুইটি ওয়াটার রিজার্ভার বসানোর কথা ছিল। কিন্তু পৌরসভার এ প্রকল্পটি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিস থেকে চিঠি আসলে আমরা ব্যবসায়ীদের জানাই। তবে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ পৌরসভা ও ফায়ার সার্ভিস। বাজারে অনেক মার্কেট আছে যেখানে পার্কিংয়ের জায়গাও ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে নোটিশ টানিয়ে দেওয়া গেলে ব্যবসায়ী ও ভবন মালিকের টনক নড়বে। অন্যথায় একটি দুর্ঘটনা ঘটলে এ বাজার রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।
ফেনী পৌরসভার সচিব আবুজর গিফারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় বাজারে ওয়াটার রিজার্ভার স্থাপনের একটি প্রক্রিয়া চলছে। জায়গা নির্ধারণের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।
হোটেল-রেস্তোরাঁয় সিলিন্ডার ব্যবহারে অগ্নি ঝুঁকির কথা তুলে ধরে ফেনী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবুল বাসার বলেন, সিলিন্ডার ব্যবহারের একটি নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালা অনুসরণ করে সিলিন্ডার ব্যবহার করলে সেক্ষেত্রে অগ্নিনির্বাপণ বা মোকাবেলা করা কিছুটা হলেও সহজ হয়। এ ছাড়া রেস্টুরেন্টগুলোতে জাঁকজমকপূর্ণ ইন্টেরিয়র থাকলেও আগুন নেভানোর জন্য হাজার টাকা দামের অগ্নিনির্বাপক নেই। এজন্য এসব জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে মানুষ অল্পতেই মারা যায় অথবা অচেতন হয়ে পড়ে।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে নোটিশ টানানো প্রসঙ্গে এ কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালে অগ্নি ঝুঁকি রয়েছে এমন ভবনে নোটিশ টানানো হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি তেমন কার্যকর নয়। আমরা আসার পরই মালিকপক্ষ সেগুলো সরিয়ে নেয়। এসবের চেয়েও সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ।
এএএ