রমজানে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে মিলছে না পণ্য
ভোক্তা সাধারণের সুবিধার্থে সরকার ২৯টি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে সম্প্রতি। নতুন মূল্য বেঁধে দেওয়ার তিন পেরিয়ে গেলেও বগুড়ার বাজারে দাম কমার কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয়ের বিষয়টিও খোদ ব্যবসায়ীরাও জানাচ্ছেন। খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দাবি, নির্ধারিত দামে পণ্য ক্রয় করতে পারলে তাদের পক্ষে বিক্রি করা সম্ভব।
এমন পরিস্থিতি দেখে হতাশ জেলার ভোক্তারা। তারা বলছেন, সরকার দাম বেঁধে দিলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বাজার মনিটরিং নেই। ফলে ওই সব পণ্যের দাম শুধু নথিভুক্ত রয়ে গেছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
সোমবার বগুড়া শহরের কলোনী, ফতেহ আলী এবং পাইকারি রাজাবাজার ঘুরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কেনাবেচার এমন চিত্র দেখা গেছে। এর আগে গত ১৫ মার্চ শুক্রবার সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে খুচরা বাজারে মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ও সবজির মতো ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়।
এসব বাজার ঘুরে দেখা যায় প্রতি কেজি সোনালি মুরগির সরকার নির্ধারিত দর ২৬২ টাকার স্থলে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৯০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির সরকার নির্ধারিত দাম ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা। এর পরিবর্তে বগুড়া শহরের সকল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে। গরুর গোশত শহরে বিক্রি হচ্ছে ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকায়। যদিও সরকার গরুর গোশতের দাম বেঁধে দিয়েছে প্রতি কেজি ৬৬৪ টাকা।
বিজ্ঞাপন
সরকার ৯৮ টাকা বেঁধে দিলেও প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। এমনিভাবে প্রতি কেজিতে ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে মুগডাল ও মাসকালাই। মসুর ডাল ও খেসারি ডালও মিলছে না বেঁধে দেওয়া দামে।
সবজির বাজারে একই অবস্থা। একমাত্র পেঁয়াজ ও বেগুন সরকার নির্ধারিত দামের নিচে পাওয়া যাচ্ছে। বাকি পণ্যগুলো বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। বেশিরভাগ সবজিই মিলছে না। মসলার বাজারে অবস্থাও একই রকম। আদা প্রতি কেজি ১৮০ টাকার স্থলে বিক্রি করা হচ্ছে ২০০ টাকায়। রসুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকার স্থলে ১৬০ টাকায়।
গরিবের পণ্য হিসেবে স্বীকৃত বগুড়ার ফতেহ আলী বাজারে প্রতি কেজি মুরগির চামড়া ১২০, পাখা ১৬০, গিলা ১৮০ আর ব্রয়লার মুরগির পায়ের কেজি ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরকার নির্ধারিত দাম কোথাও নেওয়া হচ্ছে না এমন মন্তব্য করেন ফতেহ আলী বাজারে কেনাকাটা করতে আসা তানী নামে এক নারী। পেশায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এই ক্রেতা বলেন, সত্যি বলতে যে দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার সেটা আসলে কোথাও নেওয়া হচ্ছে না। যে বাজারেই যান সবখানেই দাম বেশি। ফতেহ আলী বাজারে দাম এক রকম আবার খান্দার বাজারে আরেক রকম দাম। কোথাও দাম কমার কোনো চিহ্ন নেই। বরঞ্চ বাড়তিই নেওয়া হচ্ছে। পণ্যের যে দাম চলছে এখন সেটা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
চেলোপাড়া এলাকার শাজাহান আলী বলেন, সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে তার কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে বা হবে সেটার একটা মনিটরিং দরকার। কিন্তু আমরা তার দৃশ্যমান এখন পর্যন্ত কিছুই দেখিনি। যে মূল্য নির্ধারিত পণ্যের কোনোটাই আমরা বাজারে গিয়ে ওই মূল্যে কিনতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলে দোকানদাররা বলেন তারা ওই দামে কিনতে পারেন না। আসলে শুধু সয়ে যাওয়া ছাড়া ভোক্তাদের বলার কিছু নেই।
ফতেহ আলী বাজারের কাঁচা তরকারি ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, আসলে কাঁচা পণ্যের দাম কখনও ফিক্সড করা যায় না। পেঁয়াজ ১০০ টাকার মতো ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে সেটা ৬০ টাকায় নেমে আসছে।আবার হাট-বাজারে আমদানি কম থাকলে দাম বেড়ে যাবে। আমরা নিজেরা কোনো পণ্যের দাম বাড়াইনি। যে দামে ক্রয় করি, সেই হারে বিক্রি করতে হয়।
বেশি দামে পণ্য কেনার বিষয়টি জানান অন্য ব্যবসায়ীরাও। মুদি দোকানি মো. মিলন হোসেনের ভাষ্য, দাম কমানোর পর থেকে বসুন্ধরা ছাড়া নতুন করে তীর, রূপচাঁদা তেল আমরা পাচ্ছি না। ছোলা বুট আমাদের কেনাই পড়ছে ১০৩ টাকা। আমরা তো ১০৫ টাকাতেই বিক্রি করব। আমরা যেখান থেকে মাল কিনি তারা যদি দাম না কমায় তাহলে আমরা কীভাবে কম দামে বিক্রি করব?
মুরগী ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার বলেন, কোম্পানি যা রেট দিয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের মাল বিক্রি করতে হয়। আমরা তো সরাসরি কোনো ফার্ম থেকে মুরগি কিনি না। আমরা কিনি কোম্পানির মাধ্যমে। কোম্পানি যদি রেট কম দেয় তখন কম হবে। সরকার নির্ধারণ করেছে ঠিক আছে, কিন্তু কম দামের জন্য সরকারকে কোম্পানিকে বলতে হবে। তারা দাম কমালেই আমরা কম দামে বিক্রি করতে পারব।
ফতেহ আলী বাজারের গরুর মাংস বিক্রেতা নূর আলম বলেন, গরু কেনাই পড়ছে আমাদের কেজি প্রতি ৭০০ টাকার ওপরে সেখানে ৬৬৪ টাকা কেজিতে আমরা কীভাবে বিক্রি করব? কম দামে বিক্রি করলে এই টাকা ভর্তুকি কে দেবে? সরকার বেঁধে দিলেই তো আমরা বেচতে পারব না। দোকান বন্ধ রাখতে হবে তাহলে। হাটে গরুর দাম বেশি। ১ লাখ টাকার গরু ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। মাংসের বাজারের জন্য নতুন করে দাম নির্ধারণ করা উচিত। কারণ যে দাম বেঁধে দিয়েছে সেই দামে বিক্রি করা কখনই সম্ভব না।
রাজা বাজার আড়তদার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে। সরকার ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই দামে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরাও ভোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই আপনারা একবারে বেশি করে পণ্য ক্রয় করা থেকে বিরত থাকবেন। কারণ এটা করলে পণ্যের জোগান কমে যায়, ফলে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আর চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বেই। রোজার শুরুতে যে পণ্যের যে চাহিদা দেখা দিয়েছিল, এখন তা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে।
বগুড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইফতেখারুল ইসলাম রিজভী বলেন, আমরা মনিটরিং করছি। যেহেতু মাত্র মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, এর মধ্যে অনেক খুচরা বিক্রেতা এই মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি জানেও না। অনেক পাইকারও জানে না। এটা বাস্তবায়নে আরও ২-৩দিন সময় লাগবে। এরপরে যদি কেউ সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি না করে তবে কঠোর আইন বাস্তবায়ন করা হবে।
বাজার মনিটরিং নিয়ে বগুড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সদর উপজেলায় চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। এ ছাড়া রোজার আগের দিন থেকে বাকি উপজেলাগুলোতে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাসাইন করে দেওয়া আছে বলে দাবি করেন জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম।
সরকার নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করছেন না ব্যবসায়ীরা এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, কেনা বেশি পড়ছে এটা তারা শুধু বললে তো হবে না। আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। কোথায় বেশি রাখছে, কারা বেশি রাখছে। যে বেশি রাখছে তার বিরুদ্ধেই আমরা ব্যবস্থা নেব।
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এএএ