ঐতিহ্য ও নির্মাণশৈলীর অনন্য নিদর্শন পার্বত্য জেলা রাঙামাটির ‘কেপিএম বড় মসজিদ’। কাপ্তাইয়ের সবচেয়ে বড় কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম) এলাকায় অবস্থিত মসজিদটি।

মসজিদটির নির্মাণশৈলী দেশের অন্যান্য মসজিদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মসজিদের ভেতরে নেই কোনো স্তম্ভ বা পিলার। তাই মসজিদটি দেশের একমাত্র স্তম্ভবিহীন মসজিদের খেতাব অর্জন করেছে।

জানা যায়, ১৯৬৭ সালের ৮ ডিসেম্বর (৫ রমজান, ১৩৮৭ হিজরি) তৎকালীন দাউদ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আহমেদ দাউদ এইচ কে’র মা হাজিয়ানী হানিফা বাঈ কেপিএম আবাসিক এলাকায় মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তখন কর্ণফুলী পেপার মিল দাউদ গ্রুপের মালিকানাধীন ছিল। মসজিদটির নাম কেপিএম কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। তবে তা স্থানীয়দের কাছে ‘কেপিএম বড় মসজিদ’ নামে পরিচিত।

মসজিদটির বিশেষত্ব হলো চারপাশে চারটি দেয়াল ছাড়া ভেতরে কোনো কলাম বা পিলার নেই। মসজিদের যে কোনো পাশ থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় ইমামকে। ইমামও মুসল্লিদের দেখতে পারেন অনায়েসে। মসজিদে ২৩টি কাতার আছে। প্রত্যেক কাতারে শতাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদ ৬০টি সিলিং ফ্যান ও ৪০টি টিউবলাইট আছে।

মসজিদে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। তবে মসজিদের পরিবেশ শীতল রাখতে সামনে ও পেছনের দেয়ালে ১৬টি এবং দুই পাশের দেয়ালে ১৪টি জানালা আছে। মসজিদের সামনে ও পেছনে দুটি মূল ফটক রয়েছে। মসজিদের মেঝে মোজাইক করা। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসেবে সারাদেশ থেকে অনেকে দেখতে আসেন মসজিদটি।

মসজিদ নির্মাণের সময় কেপিএমে চাকরি করতেন আবু হানিফ মজিদ। জোহরের নামাজ পড়তে মসজিদে এসেছিলেন তিনি। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, যখন মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় তখন আমি কেপিএমে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করতাম। আমরা দেখেছি পাকিস্তানের করাচি থেকে জাহাজে করে নির্মাণসামগ্রী আনা হতো। ভারতের মুম্বাইয়ের এক ইঞ্জিনিয়ার এই নির্মাণ কাজের তদারকি করতেন। নির্মাণ শেষ হওয়ার পর ঢাকা থেকে অনেক মন্ত্রী দেখতে এসেছিলেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদও এসেছিলেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য হারাতে বসেছে দেশের ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি। পলেস্তারা খসে পড়েছে অনেক জায়গায়। ছাদের নিচের ফলস সিলিংগুলোও ভেঙে গেছে। অনেক বৈদ্যুতিক ফ্যান ও লাইট নষ্ট হওয়ার পথে।

মসজিদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন সত্তরোর্ধ্ব এই প্রবীণ। তিনি বলেন, বর্তমানে কেপিএম ম্যানেজমেন্ট মসজিদের দেখভাল করে না। তাই আমরা মসজিদে দানবাক্স বসিয়েছি। দানবাক্সের টাকায় এখন আমরা মসজিদের উন্নয়ন কাজ করি।

ফজলুল হক নামে আরেক মুসল্লি বলেন, স্বাধীনতার ৩ মাস পর আমি এই এলাকায় এসেছি। ১৯৭২ সাল থেকে এখানে নামাজ পড়ি। তখন মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন ছিল। মুসল্লির চাপে জায়গা হতো না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদটি নষ্ট হওয়ার পথে। বর্ষাকালে মসজিদে পানি ঢুকে, তখন আমাদের নামাজ পড়তে কষ্ট হয়।

তিনি বলেন, আমরা অনেকবার কেপিএম ম্যানেজমেন্টের কাছে বিষয়টি জানিয়েছি, কিন্তু তারা আমলে নেয়নি। এখন মসজিদের দানবাক্সের টাকায় টুকটাক সংস্কার কাজ চলছে।

পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মো. আবু তাহের মুন্না বলেন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি নান্দনিক দিক ফুটে উঠেছে এই মসজিদদের নির্মাণশৈলীতে। পিলার ছাড়া শুধু চার দেওয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। এমন স্ট্রাকচারের মসজিদ দেশের আর কোথাও নেই। এ কারণে সারাদেশের মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মসজিদটি।

মসজিদের ইমাম ও খতিব এ.টি.এম আবদুল্লাহ বলেন, অনেক বছর ধরে এখানে ইমামতি করছি। পিলারবিহীন হওয়ার কারণে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এটি দেখতে আসেন। এখানে একসঙ্গে প্রায় ২ হাজারের বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। বর্তমানে সংস্কারের অভাবে মসজিদটি সৌন্দর্য হারাতে বসেছে।

কেপিএম কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. আবদুল আজিজ ভুঁইয়া বলেন, মসজিদটি অনেক পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী। বর্তমানে মসজিদটি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। বর্ষাকালে মুসল্লিদের নামাজ পড়তে অসুবিধা হয়।

তিনি বলেন, কেপিএমের অবস্থায় আগের মতো ভালো না থাকায় বর্তমানে মসজিদের সংস্কার কাজ কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। মসজিদটির সংস্কারে সহায়তার জন্য আমি বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

এনটি/আরএআর