সুন্দরবনে এখনও আগুন জ্বলছে। ঘটনার প্রায় সাত ঘণ্টা পরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সোমবার (০৩ মে) বেলা ১১টার দিকে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট, বন বিভাগ, সিপিজি সদস্য ও স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। 

স্থানীয় সিপিজির টিম লিডার লুৎফর রহমান বলেন, সুন্দরবনে আগুন লাগলে বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি আমরা আগুন নেভানোর কাজে অংশগ্রহণ করি। এর আগেও আমরা ১৫-২০ জন সিপিজি সদস্য সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছি। আশা করি খুব দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। 

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের শরণখোলা স্টেশন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, এলাকাবাসী বনের মধ্যে ধোঁয়া দেখে আমাদের খবর দেন। আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছেছি। সিপিজি সদস্য, গ্রামবাসী, বন বিভাগের ভোলা ও ধান সাগর ক্যাম্পের সদস্যদের নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আনুমানিক দেড় থেকে দুই একর বন জুড়ে আগুন জ্বলছে। আগুনের চতুর্দিকে বেজ (ক্যানেল) কাটার কাজ চলছে। আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।

তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক কারণেই বনে আগুন লেগেছে। সুন্দরবনের মধ্যে শুকনো পাতার স্তূপ রয়েছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় প্রাকৃতিকভাবে এই আগুন লেগেছে। 

স্থানীয়রা বলেন, সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। কখনও আগুন লাগার কারণ আমরা জানতে পারি না। আগুন লাগলেই শুনি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। পরে আর কিছু শুনি না। সুন্দরবন আমাদের মায়ের মত রক্ষা করে। সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির কারণ আমাদের জানানো উচিত। আমাদের ধারণা বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে আগুন লাগানো হয়। 

সুন্দরবন সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছাদুজ্জামান মিলন বলেন, সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার ঘটনাগুলো স্পষ্টভাবে জানা যায় না। যখনই আগুন লাগে তখনই দায়সারা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আগুন লাগার মূল রহস্য উদ্ঘাটন হওয়া জরুরি। ভবিষ্যতে যাতে আগুন না লাগে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি। 

বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক মো. গোলাম ছরোয়ার বলেন, সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ স্টেশনের ২০ জন সদস্য কাজ করছেন। পানির উৎস পাওয়া গেছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। 

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনের দাসের ভারানি এলাকায় অল্প কিছু জায়গায় আগুন ধরেছে। যে এলাকায় আগুন ধরেছে ওই এলাকায় সুন্দরী গাছের পরিমাণ কম। ফায়ার সার্ভিস ও বন কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করছে। তদন্ত কমিটি গঠন করে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও আগুন লাগার কারণ জানানো হবে। 

গত ২০ বছরে সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগে ২৫ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে সুন্দরবনের প্রায় ৭৫ একর শতাংশ বনভূমির গাছ, বিভিন্ন ধরনের ঘাস, লতাপাতা পুড়ে যায়। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা।  

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে ২০০২ সালে শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্য এলাকায়, ২০০৪ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্প এলাকায় ও আড়ুয়াবের খালে এবং ২০০৫ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের আড়ুয়াবের খালের পশ্চিমে তুলাতলা ও খুটাবাড়ি এলাকায় আগুন লাগে। এরপরের বছর ২০০৬ সালে তেরাবেকা খালের পাড়ে, আমুরবুনিয়া, কলমতেজিয়া, পচাকুড়ালিয়া বিল ও ধানসাগর স্টেশন এলাকায় মোট পাঁচটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। 

২০০৭ সালে বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী নলবন, পচাকুড়ালিয়া বিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটে। ২০১০ সালে ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী, ২০১১ সালে ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, ২০১৪ সালে আবারও ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালেও ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, পচাকুড়ালিয়া, তুলাতলী এবং ২০১৭ সালে একই স্টেশনের মাদরাসার ছিলা নামক স্থানে আগুন লাগে। ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগার স্টেশন এলাকায় এবং সর্বশেষ ৩ মে শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ হিসেবে ২০০২ সালের ২২ মার্চ থেকে থেকে ২০২১ সালের ৩ মে পর্যন্ত ২০ বছরে ২৫ বার সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ।

তানজীম আহমেদ/আরএআর