লোকশিল্পীদের কেউ কেউ গান ছেড়ে দিয়েছিলেন। আবার কেউ যথাযথ মাধ্যমের অভাবে পড়ে ছিলেন অন্ধকারে। অর্থাভাব, অসহায়ত্ব, অসচ্ছলতা আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে জীবন হয়ে উঠেছে তাদের দুর্বিষহ। এদিকে করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ সাংস্কৃতিক সব কর্মকাণ্ড, যা তাদের জীবনকে করে তুলেছে আরও দুরূহ। চলমান এসব বাস্তবতায় যখন কেউ তাদের পাশে নেই, তখন স্বগোত্র ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট করতে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশবরেণ্য লোকশিল্পী কুদ্দুস বয়াতী।

দেশের অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত এসব লোকশিল্পীকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন কুদ্দুস বয়াতী। তিনি লোকশিল্পীদের খুঁজে বের করে তার ‘কুদ্দুস বয়াতী’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে তুলে ধরছেন অসহায় এসব লোকশিল্পীর গানসহ তাদের জীবনের নানা দুঃখগাথা। এ পর্যন্ত তার ইউটিউব চ্যানেলে গান করে ভাইরাল হয়েছেন অনেকে।

ভাইরাল হওয়া এসব লোকশিল্পীরা এখন স্বপ্ন দেখছেন কুদ্দুস বয়াতীর মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করার।

এদিকে কুদ্দুস বয়াতী সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন নিজ এলাকার লোকসংস্কৃতির উর্বরভূমি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার লোকশিল্পীদের নিয়ে। ঢাকায় বসবাস করলেও তিনি তার এলাকার লোকশিল্পীদের খোঁজখবর নিতে এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিজের ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে তুলে ধরতে প্রায়ই চলে আসেন নিজ এলাকা কেন্দুয়া উপজেলায়। অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত লোকশিল্পীদের খুঁজে বের করে তাদের বাড়িতে ছুটে যান।

জানা যায়, ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত অর্থ অসহায় এসব শিল্পীর মাঝে বিলিয়ে দেন কুদ্দুস বয়াতী। এ ছাড়া যেসব শিল্পী তার চ্যানেলে গান করে ভাইরাল হয়েছেন, তাদেরও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছেন বয়াতী। আর্থিক সহায়তা প্রদান করছেন স্থানীয় মসজিদ-মাদরাসাসহ এতিমদের সেবায়ও।

দেশবরেণ্য লোকশিল্পী কুদ্দুস বয়াতীর এমন কর্মকাণ্ডে দারুণ খুশি অসহায় লোকশিল্পীরা। তাই যখনই কুদ্দুস বয়াতীর নিজ এলাকায় আগমনের সংবাদ পান সুবিধাবঞ্চিত শিল্পীরা, তারা তার বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমান।

কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের তারাকান্দিয়া গ্রামের অসহায় ও হতদরিদ্র এক শিল্পী নুরু মিয়া। সবাই তাকে ডাকেন নুরু পাগলা বলে। বয়স প্রায় ৭০। একসময় লোকগান করতেন তিনি। একপর্যায়ে গান ছেড়ে দিয়ে তিনি অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন।

জানা যায়, ৪০ বছর পর বছর দুয়েক আগে হঠাৎ একদিন তার বাড়িতে হাজির কুদ্দুস বয়াতী। তিনি তাকে কয়েকটি গান করতে বলেন। একপ্রকার অনুরোধে তিনি করেন নুরু। তারপর ‘কুদ্দুস বয়াতী’ চ্যানেলে সেগুলো আপলোড করা হয়। তারপর ভাইরাল হয় বৃদ্ধ নুরুর সেই গান। বর্তমানে কুদ্দুস বয়াতীর ইউটিউব চ্যানেলে নিয়মিতভাবেই গান করে আসছেন এই শিল্পী।

শিল্পী নুরুর সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি গান ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু কুদ্দুস বয়াতী হঠাৎ একদিন আমার বাড়িতে এসে আমাকে তার ইউটিউব চ্যানেলে গান গাইতে বলেন। তারপর গান গাইলাম এবং আমার গান ভাইরাল হয়। এই বৃদ্ধ বয়সে আবারও গান গাইব এবং আমার গান ভাইরাল হবে, তা কখনো ভাবিনি। সবই হয়েছে কুদ্দুস বয়াতীর কারণে।

তিনি বলেন, আমার মতো অনেক অসহায় শিল্পীকে কুদ্দুস বয়াতী ভাইরাল বানিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ভাইরাল হওয়া শিল্পীদের তিনি ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত অর্থসহায়তাও করছেন। ভাইরাল শিল্পী ছাড়াও এলাকার অসহায় ও অসচ্ছল শিল্পীদের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

নুরুর মতো ‘কুদ্দুস বয়াতী’ চ্যানেলে গান করে ভাইরাল হয়েছেন কেন্দুয়াসহ আশপাশ এলাকার অন্তত অর্ধশত অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত লোকশিল্পী। ভাইরাল হওয়া এসব শিল্পীর মধ্যে রয়েছেন অলিউল্লাহ বয়াতী, আশিক বয়াতী, জসিম বয়াতী, গোলাম মোস্তফা, বাউল শামীম ও বাউল সালাম সরকারসহ অনেকেই।

একই রকম অনুভূতি ব্যক্ত করেন লোকশিল্পী অলিউল্লাহ বয়াতী, আশিক বয়াতী, জসিম বয়াতীসহ অন্যরাও। তারা বলেন, কুদ্দুস বয়াতীর ইউটিউবে ভাইরাল হওয়ার পর আমাদের মতো অসহায় লোকশিল্পীদের মর্যাদা আগের অনেক বেড়েছে এবং বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানেও আমরা আমন্ত্রণ পাচ্ছি। দুঃখ-দুর্দশাও অনেকটাই লাঘব হচ্ছে। তবে করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় তারা বর্তমানে বেকার অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন বলেও জানান।

এ নিয়ে কুদ্দুস বয়াতীর সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জীবনে বহু সংগ্রাম করে আমি আজ কুদ্দুস বয়াতী হয়েছি। আমি হাওরাঞ্চলের কাদামাটি থেকে উঠে এসেছি। তাই লোকশিল্পীদের দুঃখ-কষ্ট বুঝি। লোকশিল্পীদের অধিকাংশই অসচ্ছল ও অসহায়। তারা নিজের জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছেন। অনেকেই বর্তমানে অসুস্থ। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। কারও ঘরে ভাত নেই। পরিবার নিয়ে কেউ কেউ আবার মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। এ জন্যই তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো।

বর্তমান সরকার দেশের লোকশিল্পীদের নানাভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি এ সহায়তা সাময়িক উপকারে এলেও স্থায়ীভাবে কোনো কাজে আসছে না। তাই সাময়িকভাবে কিছু টাকা সহায়তা বা অনুদান না দিয়ে লোকশিল্পীদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর তা বাস্তবায়নের জন্য সারাদেশের লোকশিল্পীদের একটা তালিকা তৈরি করে অবিলম্বে ভাতা প্রদানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

কুদ্দুস বয়াতী বলেন, আমি আমার ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত অর্থ অসহায় লোকশিল্পীসহ এলাকার মসজিদ-মাদরাসায় বিলিয়ে দিয়ে আসছি। একটি এতিম মেলা করার দায়িত্ব নিয়েছি। তবে আমার একার পক্ষে সারাদেশের লোকশিল্পীদের সহযোগিতা করা সম্ভব নয়। এ জন্য দেশের বিত্তশালী লোকজন ও সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। তবেই অসহায় লোকশিল্পীরা বেঁচে থাকবে।

কেন্দুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুদ্দুস বয়াতী আমাদের দেশের সম্পদ। আমাদের গর্ব ও অহংকার। তিনি তার ইউটিউবের মাধ্যমে দেশের অসহায় লোকশিল্পীদের বর্তমান জীবনযাপন তুলে ধরছেন। আর্থিক সহায়তা করে যাচ্ছেন। এ জন্য আমি কুদ্দুস বয়াতীকে ধন্যবাদ জানাই।

কুদ্দুস বয়াতীর এমন কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান বলেন, কুদ্দুস বয়াতী একেবারে নিভৃত পল্লি থেকে অসহায় ও মেধাবী লোকশিল্পীদের খুঁজে বের করে তার ইউটিউব চ্যানেলে তুলে ধরছেন। কুদ্দুস বয়াতীর মতো দেশবরেণ্য প্রত্যেক শিল্পীরই দেশের অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

তবে সরকারের পক্ষ থেকেও অসচ্ছল, অসহায় ও অসুস্থ শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

এনএ