কাঠুরে বাবার স্বপ্নপূরণ আর বাধা থাকল না। মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই আর্থিক সংকট দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল আবু বকরের পরিবারকে। ছেলের মেডিকেলে ভর্তি নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছিলেন বাবা-মা। সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে শাহিন আলম নামের এক সিঙ্গাপুরপ্রবাসী আবু বকরের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

গত ১৯ মে সকালে বিদেশ থেকে মেডিকেলে ভর্তির জন্য আর্থিক সহায়তার জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে আবু বকরের পরিবারের কাছে অনুদান প্রদান করেন।

পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার সিঙ্গাপুরপ্রবাসী শাহীন আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকাশিত সংবাদ দেখে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া অসহায় ছেলেটি সম্পর্কে জানতে পেরে তার পরিবারকে কিছু অর্থ সহযোগিতা করেছি। তার সম্পর্কে চমৎকার প্রতিবেদন আমার হৃদয়ে নাড়া দেয়।

তিনি বলেন, প্রবাসে বসে অবসর সময়ে নিজ দেশের প্রথম সারির অনলাইন সংবাদ ফলো করি, তার মধ্যে অন্যতম ঢাকা পোস্ট.কম। মানবিক খবরগুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে পড়ি, সেগুলো নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অনুসন্ধান করে প্রকৃত দরিদ্র হলে তাকে সহযোগিতা করি। দেশের অসহায়দের জন্য যতদূর সম্ভব পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমাদের সবার উচিত যার যার স্থান থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করা। আবু বকরকে মেডিকেলে পড়াশোনা করার জন্য ভবিষ্যতে সহযোগিতা অব্যাহত থাকার কথাও জানান তিনি।

আবু বকরের বাবা আবু সাঈদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলেটাকে ঠিকমতো লেখাপড়ার খরচ দিতে পারিনি। তারপরও নিজের আগ্রহে কঠিন পরিশ্রম করে লেখাপড়া অব্যাহত রেখেছে। এখন ছেলে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। শুনেছি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করতে অনেক টাকাপয়সা লাগে। কিন্তু এত টাকা আমি কোথায় পাব? এখন এই চিন্তা কিছুটা হলেও দূর করেছে এক প্রবাসী ভাই। তিনি আমার ছেলের মেডিকেলে ভর্তির জন্য আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার কাছে পুরো পরিবার চিরকৃতজ্ঞ থাকব। সেই সঙ্গে তিনি ঢাকা পোস্ট.কমকেও অসংখ্য ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, একসময় মনে করতাম গণমাধ্যম শুধু খেলাধুলা সিনেমা দেখানোর জন্য, এখন দেখি গরিব মানুষদের পাঁশে দাড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয় গণমাধ্যম।

আবু বকরের মা হাফিজা বেগম বলেন, আমার ছেলের মেডিকেলে ভর্তির জন্য কেউ সহযোগিতা করবে স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রবাসী এক ভাই আমার ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য আশ্বাস দিয়েছেন। এটা আমাদের জন্য একটি বড় পাওয়া। তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি।

আবু বকর বলেন, মেডিকেলে সুযোগ পেয়েও স্বপ্নপূরণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে থেমে যেতে হচ্ছিল। কারণ, বাবার তেমন কোনো অর্থ নেই যে মেডিকেলে পড়াবে। খুব চিন্তা কাজ করছিল, সেই সময় আপনাদের প্রতিবেদন প্রচার করার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি সংগঠন ও এক প্রবাসী আংকেল আমার পাঁশে দাঁড়িয়েছে, এটা আমার জন্য বিরাট পাওয়া। মেডিকেলে পড়াশোনা করা আমার জন্য সহজ হবে। আমি সবার সহযোগিতায় পড়াশোনা শেষ করে ভালো চিকিৎসক হতে চাই। চিকিৎসাবঞ্চিতদের জন্য কাজ করব, মানসম্মত সেবা দিয়ে তাদের কৃতজ্ঞ পরিশোধ করার চেষ্টা করব।

২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস-এ পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন আবু বকর। সাঁথিয়া উপজেলার ধোপাদহ ইউনিয়নের গোপালপুর শাহপাড়া গ্রামের আবু সাঈদ ও হাফিজা বেগম দম্পতির ছেলে আবু বকর। তিন সন্তানের মধ্যে আবু বকর মেজো। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা একজন কাঠুরে। বাড়ির ১০ হাত জায়গা ছাড়া তেমন কোনো জায়গাজমি নেই তাদের। বাড়িতে একটি মাত্র ছোট জরাজীর্ণ দোচালা টিনের ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন পরিবারের সবাই।

আবু বকরের পরিবারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। মেডিকেলে ভর্তি ও পড়ার খরচ জোগানো তার বাবার জন্য আকাশকুসুম কল্পনা। তার বাবা কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করলেও হাতের সমস্যার কারণে বর্তমানে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কাঠের খড়ি বিক্রি করে কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন।

আর্থিক সংকট থাকলেও আবু সাইদ ছেলেকে মানুষ করে গড়ে তুলতে কার্পণ্য করেননি। রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বড় ছেলে ওমর আলী সাঁথিয়া সরকারি কলেজে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় ছেলে আবু বকর। তৃতীয় ছেলে আবদুল্লাহ স্থানীয় নাড়িয়াগদাই উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।

চরম দরিদ্র ও টানাটানির সংসার হওয়া সত্ত্বেও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ছেলেদের পড়াশোনা করাচ্ছেন আবু সাইদ। তার আশা, সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশের সেবা করবে, সংসারের হাল ধরবে, পরিবারের অভাব দূর করবে।

পারিবারিক সূত্র জানায়, আবু বকর ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ও পরিশ্রমী ছিলেন। পিইসি ও জেএসসিতে মেধাবৃত্তি পেয়ে পরিবারে আশার আলো দেখান। এরপর নাড়িয়াগদাই উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান। ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন) পেয়ে পরিবার ও শিক্ষকদের মুগ্ধ করেন। পরে শিক্ষকরা তাকে সাহস দেন বিশ্ববিদ্যালয় অথবা মেডিকেলে পড়াশোনার ব্যাপারে। অবশেষে ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করে মেডিকেলে উত্তীর্ণ হয়ে সবার আস্থার প্রতিদান দেন আবু বকর।

এর আগে ১৫ এপ্রিল ‘কাঠুরে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চান আবু বকর’ শিরোনামে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি প্রবাসী শাহীন আলমের নজরে এলে তিনি আবু বকরের পরিবারের খোঁজখবর নেন। মেডিকেলে ভর্তির জন্য ২৬ হাজার টাকা পাঠান।

রাকিব হাসনাত/এনএ