আবু বকরের বাবা কাঠ কেটে সংসার চালান। তবে সবসময় স্বপ্ন দেখতেন ছেলেকে চিকিৎসক বানাবেন। তার সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হওয়ার পথে। কিন্তু আর্থিক সংকট পরিবারটিকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ছেলের মেডিকেলে ভর্তি নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন বাবা-মা।

২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস-এ ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন আবু বকর। তিনি পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।

আবু বকর পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধোপাদহ ইউনিয়নের গোপালপুর শাহপাড়া গ্রামের আবু সাঈদ ও হাফিজা বেগম দম্পতির ছেলে। তিন সন্তানের মধ্যে আবু বকর মেজো। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা একজন কাঠুরে। বাড়ির ১০ হাত জায়গা ছাড়া তেমন কোনো জায়গাজমি নেই তাদের। বাড়িতে একটিমাত্র ছোট জরাজীর্ণ দোচালা টিনের ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন পরিবারের সবাই।

আবু বকরের পরিবারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। মেডিকেলে ভর্তি ও পড়ার খরচ জোগানো তার বাবার জন্য আকাশকুসুম কল্পনা। তার বাবা কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করলেও হাতের সমস্যার কারণে বর্তমানে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কাঠের খড়ি বিক্রি করে কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন।

আর্থিক সংকট থাকলেও আবু সাইদ ছেলেকে মানুষ করে গড়ে তুলতে কার্পণ্য করেননি। রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বড় ছেলে ওমর আলী সাঁথিয়া সরকারি কলেজে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় ছেলে আবু বকর। তৃতীয় ছেলে আবদুল্লাহ স্থানীয় নাড়িয়াগদাই উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।

চরম দরিদ্র ও টানাটানির সংসার হওয়া সত্ত্বেও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ছেলেদের পড়াশোনা করাচ্ছেন আবু সাইদ। তার আশা- সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশের সেবা করবে, সংসারের হাল ধরবে, পরিবারের অভাব দূর করবে। 

পারিবারিক সূত্র জানায়, আবু বকর ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ও পরিশ্রমী ছিলেন। সব শ্রেণিতেই তিনি প্রথম স্থান অর্জন করতেন। পিইসি ও জেএসসিতে মেধাবৃত্তি পেয়ে পরিবারে আশার আলো দেখান। এরপর নাড়িয়াগদাই উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান। ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন) পেয়ে পরিবার ও শিক্ষকদের মুগ্ধ করেন। পরে শিক্ষকরা তাকে সাহস দেন বিশ্ববিদ্যালয় অথবা মেডিকেলে পড়াশোনার ব্যাপারে। অবশেষে ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করে মেডিকেলে উত্তীর্ণ হয়ে সবার আস্থার প্রতিদান দেন আবু বকর।

ঢাকা পোস্ট কথা বলেছে আবু বকরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভালো ফল অর্জন করার মধ্য দিয়ে একটা স্বপ্ন লালন করেছিলাম। যেটা কাউকে কোনোদিন বলিনি। শুধু মনের ভেতরে চাপা জেদ নিয়ে পড়াশোনা করেছি। একটাই চিন্তা ছিল, আমাকে ভালো চিকিৎসক হতে হবে। আমাকে দেখে যেন বলে ‘গরিবের চিকিৎসক’। এখন অনেক জায়গায় ডাক্তাররা দায়সারা চিকিৎসা দিয়ে চলে যান। আমি তাদের চেয়ে ব্যতিক্রমী সেবা দেবো। চিকিৎসক হয়ে চিকিৎসাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব।

পড়াশোনার জন্য আবু বকর ঠিকমতো বইখাতা কিনতে পারতেন না। ভালো জামাকাপড় পরতে পারতেন না, অতীতের এমন স্মৃতিতে কাতর হয়ে তিনি বলেন, বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। জোর করে কিছু চাইতাম না। আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া, আমি দরিদ্র পরিবার থেকে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। মা-বাবার অনুপ্রেরণা আর শিক্ষকদের সহযোগিতায় কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে মেডিকেলের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম।

বর্তমান চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আবু বকর বলেন, ছোটবেলায় হাসপাতালে গেলে রোগীদের হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসার অভাবে কাতরানো দেখে ভালো লাগত না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, চিকিৎসক হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াব। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে থেমে যেতে হচ্ছে। কারণ, আমার বাবার তেমন কোনো অর্থ নেই। মেডিকেলে সুযোগ পাওয়ার পর এখন খুব চিন্তা হচ্ছে। আমি সবার সহযোগিতায় পড়াশোনা শেষ করে ভালো চিকিৎসক হতে চাই। চাই দেশ ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করতে। 

আবু বকরের চাচা আবদুল মজিদ তার ভাতিজার বিষয়ে উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, আমার ভাতিজা মেডিকেলে চান্স পাবে, কোনোদিন ধারণাও করিনি। এলাকার লোকেরা এখনো বিশ্বাস করছে না এত দরিদ্র ঘরের ছেলে মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হবে। আশপাশের কয়েকটি গ্রামে তাকে নিয়ে আলোচনা চলছে। সত্যিই আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।

আবু বকরের বাবা আবু সাঈদ বলেন, ছেলেটাকে ঠিকমতো লেখাপড়ার খরচ দিতে পারিনি। তারপরও নিজের আগ্রহে কঠিন পরিশ্রম করে লেখাপড়া অব্যাহত রেখেছে। এখন ছেলে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। শুনেছি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করতে অনেক টাকাপয়সা লাগে। কিন্তু এত টাকা আমি কোথায় পাব?

ছেলের ডাক্তারি পড়ার খরচ তার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয় বলে জানান আবু সাইদ। তাই তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, সংস্থা ও বিত্তশালীদের সহযোগিতা কামনা করেন।

আবু বকরের মা হাফিজা বেগম বলেন, ছেলেকে প্রাইমারি পড়াশোনা শেষে উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার জন্য দিলাম, কিন্তু পরিবারের আর্থিক অনটন দেখে গ্রামের লোকেরা তিরস্কার করত। কটু কথাও শুনতে হয়েছে। তারা বলত, গরিব মানুষের বেটারে আবার এত দূর লেখাপড়া শেখায়? ছেলেকে লেখাপড়া না শিখিয়ে অন্য কোনো কাজে দিয়ে দাও, মিস্ত্রি কাজ শেখাও। আমি লোকের কথায় কান না দিয়ে ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছি। ছেলের জন্য ভালো কাপড়, মাথায় তৈল নিতে পারি নাই, কাঁথা সেলাই করে ছেলের প্রাইভেট খরচ ও বইখাতা কেনার টাকা জোগাড় করেছি- বলেই কেঁদে ফেলেন। তিনি আরও বলেন, আজ আমার ছেলে মেডিকেলে পড়ার জন্য ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, এটা বড়ই সৌভাগ্যের কথা।

হাফিজা বেগম বলেন, এমনিতেই ছেলেকে পড়াশোনা করানোর জন্য অনেক ধারদেনা করেছি। এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। ব্যাংক থেকে ঋণ না নিলে ছেলেকে ভর্তি করাতে পারব না। তাই সরকারের কেউ বা বিত্তশীলদের কেউ যদি একটু সুনজর দেয়, তাহলে আমার ছেলের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।

এ বিষয়ে নাড়িয়াগদাই উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই আবু বকর খুবই ভদ্র, সহজ-সরল, বিনয়ী ও পরিশ্রমী ছিল। তাকে নিয়ে আমাদের ভরসা ছিল। সে কোনো সময় কারও সঙ্গে বাজে আড্ডা দেয়নি। আমরা গর্ব করতাম সে একদিন আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। সত্যিই তার মেডিকেলে ভর্তি আমাদের জন্য খুশির খবর। তার স্কুলজীবনে অনেক সহযোগিতা করেছি। চিকিৎসক হওয়া পর্যন্ত তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম জামাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম আবু বকর দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এটা আমাদের জন্য একটা বড় পাওয়া বলে মনে করি। খোঁজখবর নিয়ে অসহায় ছেলেটির পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব।

এনএ/জেএস