বাড়িতে জাল বুনছেন জেলে মো. আউয়াল শিকদার

‘বয়সের ভারে এখন আর চলতে পারি না, কাজ করতে পারি না। চার ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার জীবন চলে কচা নদীর বুকে মাছ ধরে। আগে সাগরে মাছ ধরতে গেলেও এখন নদীর বাইরে যেতে ভয় হয়। আমার বর্তমান বয়স ৭২ বছর। বাবাকে দেখে এই পেশা বেছে নিয়েছিলাম। বাঁচতে হলে এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। পড়াশোনা করি নাই বললেই চলে। ভেন্ডি, বাঁধা, সরবরসহ নানা জালের সমারোহে চলে আমাদের এই জেলে জীবন। দুর্যোগ যখন শুরু হয় তখন মহাবিপদে পড়তে হয়।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পিরোজপুর সদর উপজেলার ৭ নম্বর শংকরপাশা ইউনিয়নের মৃত তাসেন আলী শিকদারের ছেলে জেলে মো. আউয়াল শিকদার।

তিনি জানান, পিরোজপুর সদর উপজেলার ৭ নম্বর শংকরপাশা ইউনিয়নের দক্ষিণ বাদুরা গ্রামের জেলে পল্লীটি একটি নিচু এলাকা। যে কারণে পানি বাড়লেই ঘরবাড়ি ডুবে যায়। আবার পানি কমে গেলে ঘরবাড়ি শুকিয়ে যায়। প্রতিনিয়ত মাছ ধরতে যেতে হয় জোয়ারের পানির ওপর নির্ভর করে। যখন পানি বাড়ে তখন কিছু মাছ পাওয়া যায়। আসলে নদীতে আগের মতো কোনো মাছ পাওয়া যায় না। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে মাছ মোটামুটি পাওয়া যায়। যা পাওয়া যায় তাতে টানাটানির মধ্যে সংসার চালাতে হয়। জালে মাছ উঠলে চুলায় হাড়ি চড়ে। 

জেলে আউয়াল শিকদার বলেন, ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে এই মাছ ধরার কাজে জড়াইছি। লেখাপড়া কপালে জোটে নাই। সাগরে ট্রলার পাঠাইতে ২২ থেকে ২৮ জন লোক লাগে। সেই ট্রলার সাগরে যাওয়ার পর ফিরবে কিনা নিশ্চয়তা নাই।

তিনি বলেন, কচা নদীতে কয়েকবার নৌকা নিয়ে বের হলে কিছু মাছ পাওয়া যায়। পরিবার নিয়ে দুমুঠো খেয়ে ভালো থাকার জন্য আমাদের এই সংগ্রাম। তার মধ্যে সরকার বছরের ১২ মাসের ৮/৯ মাসই অবরোধ দিয়ে রাখে। এমনিতেই মাছ পাই না তার মধ্যে অবরোধ দিলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। অবরোধ চলাকালে সরকার যে সহযোগিতা দেয় তাতে আমাদের কিছুই হয় না।

জেলে আউয়াল শিকদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন বয়স হয়ে গেছে, আর পারি না।  ছেলেরাই সব করে। মাছ যারা ধরে জেলেদের অবসরের সময় হয় না। আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে একটু মাছ হয়। 

তিনি আরও বলেন, সরকারিভাবে যে ৩০/৩৫ কেজি চাল দেওয়া হয় তা আবার সবাই পায় না।  আমাদের ঘরে চারজনের একজনকে দিয়েছে। আবার অনেক ঘরে তিনজনকে দিয়েছে। আবার সেই চাল আনতে গেলে ১০০ টাকা করে দেওয়া লাগে।

জেলে ইদ্রিস আকনের স্ত্রী তাসলিমা বেগম ও বশির হাওলাদারের স্ত্রী রেহেনা বেগম বলেন, শুধু জেলে কার্ডের চাল পাই। চেয়ারম্যান মেম্বার কিছুই দেন না। একটা সামান্য কম্বল চাইছিলাম দেয় না। শুধু ভোট দেওয়ার সময় চেয়ারম্যান মেম্বার চেনে। ঘরবাড়ি নাই, বন্যায় সব শেষ। আমাদের ঘর দেয় না। ৬৫ দিনের অবরোধে আমাদের কোনো সহায়তা না করলে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। 

দক্ষিণ উপকূলীয় মৎস্যজীবী কল্যাণ সমিতি পিরোজপুর জেলা শাখার সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, এক সময় এই নদীতে প্রচুর মাছ ছিল। মাছ ধরে অসংখ্য জেলে জীবিকা নির্বাহ করতেন। যেভাবে অবরোধ চলছে তাতে অনেকে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। নদীতে এমনিতেই কোনো মাছ নাই। আবার ২০ মে থেকে ৬৫ দিনের অবরোধ শুরু হয়েছে। অবরোধ চলাকালে এই অঞ্চলের অনেককে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হবে। সরকার যে সহায়তা দেয় সেটা সামান্য। 

এ ব্যাপারে ৭ নম্বর শংকরপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জেল হোসেন মল্লিক স্বপন জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এখন ভিজিএফ কর্মসূচি চালু আছে। এর আওতায় প্রতিমাসে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে সরকার ভিজিএফের চাল বিতরণ করে। এই সহযোগিতা যারা পায় তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া যায় না। ভিজিএফ ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচি আপাতত নেই। 

তিনি বলেন, জেলেদের তালিকা ইউপি সদস্য ছাড়া আমরা চূড়ান্ত করতে পারি না। জেলা প্রশাসকের মনোনীত ব্যক্তির মাধ্যমে জেলেদের তালিকা হয়। এ ক্ষেত্রে অন্য কেউ ঢুকলে আমাদের কিছু করার থাকে না।  

এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল বারি বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য ৬৫ দিনের অবরোধ দেওয়া হয়েছে। পিরোজপুরে ২৪ হাজার ৯৬ জন নিবন্ধিত জেলে আছেন। প্রথম কিস্তিতে ১৪ হাজার ৭৫০ পরিবারকে ভিজিএফের চাল দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তির ভিজিএফের চাল বিতরণ চলমান রয়েছে। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্টের আওতায় আমরা মৎস্য গ্রাম করেছি। যেখানে সরকারি সহায়তা প্রদান করা হবে। ইলিশ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উপকরণ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা চালু করা হবে।  

এ ব্যাপারে পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, ইলিশ সংরক্ষণে সরকার জেলেদের বিপুল পরিমাণ সহযোগিতা দিয়ে থাকে। বছরে চার মাস জেলেদের মাঝে ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হয়। এই চাল বিতরণে অনিয়ম হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেসব জেলেদের ঘর নেই তাদের ঘর দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা জায়গা পেলেই তাদের ঘর দিব।

আরএআর