কথিত ভণ্ড পীর শামীমের সঙ্গে ভক্তরা

নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত— কোনোটারই প্রচলিত নিয়ম সঠিক নয়। কথিত পীর শামীমের বাঁশবাগানের দরবারে অনুসারীদের হজে আসতে হবে। কয়েক দিন আগেই এক মুসলিম কিশোরকে ঢাকঢোল বাজিয়ে দাফন করেছেন শামীম নামের ওই ভণ্ড পীর।

স্থানীয় সংসদ সদস্য, ইউপি চেয়ারম্যানসহ এলাকার সাধারণ মানুষ অবিলম্বে এসব ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধের পাশাপাশি ভণ্ড শামীমের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

দৌলতপুরে শামীমের নানা অসংগতিপূর্ণ কাজের ভিডিও আর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন ভাইরাল। তবুও বহাল তবিয়তে নিজের মনগড়া ধর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন ফিলিপনগর ইউনিয়নের শামীম।

অসংগতিপূর্ণ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এলাকায় সৃষ্টি হওয়া চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির অনুসন্ধানে যান চিত্রসাংবাদিক হাবিবুর রহমান ও রিপোর্টার আহমেদ রাজু। এ সময় সংবাদ সংগ্রহে বাধার শিকার হন তারা।

কথিত গুরুদেব শামীমের ডেরায় ঢুকতে শুরুতেই জুতা খুলে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হয় দুইশ গজের পথ। সাংবাদিকদের প্রবেশ দেখে মিনিট খানেকের মধ্যে হাজির হয় পাঁচ থেকে সাতজন তরুণ এবং আট-দশজন নারী। অনুমতি সাপেক্ষে নিজের জীবনযাপনের ব্যাখ্যা চাওয়া হয় শামীমের কাছে।

তখনই তিনি জানিয়ে দিলেন, বিশ্বব্যাপী চলা ইসলাম চলছে ভুল নিয়মে, তিনি যে দর্শনচর্চায় জীবনযাপন করছেন সেটিই ইসলামের সঠিক রূপ। যে রূপে সন্ধ্যা হলে নারী-পুরুষের নাচ-গান (স্থানীয়দের দাবি অশ্লীল নাচ-গান), ঢাকঢোল বাজিয়ে মুসলমানদের দাফন, হরে শামীম উলুধ্বনি, শামীমের পায়ে সিজদাহ চলে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের প্রচলিত ধর্মীয় কানুন আর কোরানের নির্দেশকে সরাসরি ভুল বলে দাবি করছেন এই ব্যক্তি।

আলাপচারিতা শেষে এলাকাবাসীর বক্তব্য গ্রহণের সময় শামীমের ডেরায় চিত্রসাংবাদিক হাবিবের ওপর হঠাৎ চড়াও হন এক তরুণ। এ সময় সংবাদকর্মীরা তার পরিচয় জানতে চাইলে দ্রুত সটকে পড়েন তিনি।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো ভিডিও এবং ছবি ভাইরাল হলে এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এরপর এক সন্ধ্যায় ফিলিপনগর দারোগার মোড় এলাকায় নিজেদের লোকজন নিয়ে শোডাউন দেন শামীম।

ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ভণ্ড শামীম আয়েশি ভঙ্গিতে ফুলের মালা গলায় দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। চারদিক থেকে তাকে ঘিরে রেখে নারী-পুরুষরা নেচে-গেয়ে ‘হরে হরে, হরে হরে, হরে শামীম, হরে শামীম’ বলে সবাই চিৎকার করছেন। শামীম একটি বড় গামলায় দুই পা দিয়ে রেখেছেন। আর ভক্তরা দুধ দিয়ে তার পা ধুয়ে দিচ্ছেন, কেউবা চুমু খাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার হামাগুড়ি দিয়ে পায়ে মাথা ঠুকে তাকে সিজদা করছেন।

এর আগে গত ১৬ মে রাতে পশ্চিম-দক্ষিণ ফিলিপনগর গ্রামের মহাসিন আলীর কিশোর ছেলে আঁখি (১৭) ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। মহাসিন আলী ওই গ্রামের কথিত ভণ্ড পীর শামীমের অনুসারী হওয়ায় ছেলের মরদেহ তার হাতে তুলে দেন। ওইদিন রাতে শামীম তার অনুসারীদের নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে নেচে-গেয়ে আঁখির মরদেহ দাফন করেন।

পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় আলেম-ঈমাম-মুয়াজ্জিনদের নেতৃত্বে সমাবেশ আহ্বান করা হলেও পুলিশের আশ্বাসে তা থেমে যায়। সংশ্লিষ্ট এলাকার মুসলিম ও ইসলাম ধর্ম প্রসঙ্গে জানাশোনা ভালো এমন ব্যক্তিরা ঘুরছেন উপজেলা প্রশাসন আর দৌলতপুর পুলিশের দ্বারে দ্বারে। তবে এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি নন দৌলতপুর থানার ওসি নাসির উদ্দিন।

স্থানীয়রা জানান, শামীমের ভক্ত-অনুসারীদের বেশিরভাগই অল্প বয়সী তরুণ-তরুণী। শামীম নিজে এবং তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অনুসারী অশিক্ষিত এবং অল্প শিক্ষিত মানুষজনকে মগজ ধোলাই করে শিষ্যত্ব লাভে বাধ্য করেন। দুই বছর ধরে তার আস্তানায় ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড চললেও মূলত গত ১৬ মার্চ আাঁখি নামের কিশোরের লাশ ঢোল-তবলা বাজিয়ে দাফন করার পর থেকে শামীম সবার আলোচনায় চলে আসেন।

শামীম রেজা মৃত জেসের মাস্টারের ছেলে। শামীম পশ্চিম-দক্ষিণ ফিলিপনগর গ্রামের ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৮৪ সালে ফিলিপনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। কুমারখালী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ভেড়ামারা কলেজ থেকে বিকম পাস করে পরবর্তীতে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এমকম পাস করেন।

পড়ালেখা শেষ করে ঢাকার জিনজিরা এলাকায় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন শামীম রেজা। পরবর্তীতে ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলাম-এ-বাবা কালান্দার জাহাঙ্গীর সুরেশ্বরীর মুরিদ হন এবং খাদেম হিসেবে সেখানে বসবাস শুরু করেন। মুরিদ হওয়ার পর থেকে শামীম পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরিবারের সদস্যরা অনেক খোঁজাখুজি করেও শামীমের সন্ধান লাভে ব্যর্থ হন।

২০০৭ সালে শামীম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু সে বিয়ে দুই-তিন মাসের বেশি টেকেনি। প্রায় বছর দুয়েক আগেই হঠাৎ করেই শামীম নিজ গ্রাম ইসলামপুর ফিরে আসেন এবং তার বাড়িতেই আস্তানা গড়ে তোলেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া প্রায় দুই বিঘা জায়গা নিয়ে শামীম বসবাস শুরু করেন। সেখানেই তার আস্তানা।

দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার বলেন, শামীমের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড জানার পর আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সর্তক করে দিয়েছি। এ ব্যাপারে কেউ তার বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সুবিধা হবে।

এ প্রসঙ্গে শামীমের সহোদর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ফজলুর রহমান (সান্টু মাস্টার) বলেন, যত দ্রুত সম্ভব তাকে বিচারের আওতায় নেওয়া উচিত। তার কর্মকাণ্ডে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ।

দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা বলেন, শামীমের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ কোনো লিখিত অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম সারোয়ার জাহান বাদশা বলেন, আমরা একই গ্রামের মানুষ। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় শামীম নিখোঁজ ছিল। ইসলামের নামে সে আস্তানা বানিয়ে যা করছে তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

এমএসআর