নগরায়ণের এই সময়ে শহরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সক্রিয় রাখা প্রধান কাজ। একদিকে কোটি মানুষের শহরে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সংশ্লিষ্ট দফতরকে হিমশিম খেতে হয়, অন্যদিকে বাসিন্দাদের অসদিচ্ছা আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অক্ষমতায় বন্ধ হয়ে যায় ড্রেন। এতে স্থবির হয়ে পড়ে পয়োনিষ্কাশনপ্রণালি। সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।

ড্রেনের পানি ও বর্জ্য মাটির উপরিভাগে উঠে এলে নানা ধরনের রোগজীবাণুর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গুর মতো ভয়ংকর রোগের তালিকা দীর্ঘ হয়। ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড তো আছেই। এ ছাড়া পানি ও মাটিদূষণে ভারসাম্য হারায় পরিবেশ।

এসব অবস্থা থেকে বাঁচতে ‘অটো ড্রেন ক্লিনার’ উদ্ভাবন করেছেন বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের মধ্যম পাংশা গ্রামের তরুণ উদ্ভাবক ওবায়েদুল ইসলাম।

তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রেন পরিষ্কার হয়ে যাবে। একই সঙ্গে ড্রেনের ময়লা ও পানি আলাদা হয়ে পানি চলে যাবে নদী বা খালে। ওদিকে মানবসৃষ্ট আবর্জনা নির্ধারিত স্থানে জমা হবে। তবে চমকপ্রদ তথ্য হলো, অটো ড্রেন ক্লিনার পদ্ধতিতে শহরের ড্রেন পরিষ্কার করতে একজন জনবলেরও দরকার হবে না। আর পুরো প্রকল্পটি চলবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে।

জানতে চাইলে ওবায়েদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অটো ড্রেন ক্লিনার হচ্ছে একটি শহর পরিচ্ছন্ন রাখার মডেল প্রযুক্তি। এটি বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়িত হলে নগর কর্তৃপক্ষ পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের ব্যয় কমবে। লোকবলের দরকার হবে না। সেই শ্রমশক্তি অন্যত্র ব্যবহার করে সমৃদ্ধি আনতে পারবে। পাশাপাশি সময়মতো প্রতিদিন ড্রেন পরিষ্কার হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

অটো ড্রেন ক্লিনার কী এবং এর কাজের পরিধি কত, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অটো ড্রেন ক্লিনার হচ্ছে সেন্সর-নির্ভর এবং মাইক্রো প্রসেসর নিয়ন্ত্রিত একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতির সেন্সরের কাজ ড্রেনে ময়লা-আবর্জনার স্তর শনাক্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই স্তর ভেঙে দিয়ে প্রেসার পাম্পের মাধ্যমে পানির গতি বাড়িয়ে নির্ধারিত দূরত্বে ময়লা-আবর্জনা পৌঁছে দেওয়া। সর্বশেষ সেন্সরটি থাকবে ড্রেনের ‘বহির্গমন’ পয়েন্টে। সেখানে ড্রেনের পানি নদী/খালে নির্গমন না হয়ে যদি উল্টো প্রবেশ করে, তাহলে বহির্গমন পয়েন্টের সেন্সর সক্রিয় হয়ে নদী বা খালের পানির স্তর ড্রেনের পানির স্তরের নিচে না নেমে আসা অবধি পুরো প্রক্রিয়াটি নিস্ক্রিয় করে রাখবে।

তরুণ এই উদ্ভাবক উদাহরণ টেনে বলেন, শহরের ময়লা-আবর্জনা ড্রেনের নির্ধারিত পয়েন্ট থেকে ফেলা হলে ড্রেনের পানির স্বাভাবিক গতির সঙ্গে মিশে একটি নির্ধারিত দূরত্বে গিয়ে জমাট বাঁধতে থাকবে। ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা যদি প্রথম স্তর পর্যন্ত জমাট বাঁধে, তাহলে সেন্সরের সিগন্যালের মাধ্যমে প্রথম প্রেসার পাম্পটি চালু হয়ে ময়লা-আবর্জনার জমাট বাঁধা অংশের ওপর প্রবল গতিতে পানি ছুড়ে তা ভেঙে দেবে। ড্রেনের স্বাভাবিক পানি ও প্রেসার পাম্পের ছোড়া পানি মিলে ময়লা-আবর্জনা নির্গমন মুখের দিকে স্রোতে ভেসে যাবে।

পানিপ্রবাহের গতি কমে গিয়ে যেখানে দ্বিতীয় স্তর গড়ে তুলবে, সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্বিতীয় সেন্সরের সিগন্যালে প্রেসার পাম্প চালু হয়ে পানিপ্রবাহ বাড়িয়ে দেবে। এভাবে ড্রেনের বহির্গমন পয়েন্ট পর্যন্ত ময়লা-আবর্জনা পানিপ্রবাহের মাধ্যমে পৌঁছে দেবে সেন্সর ও প্রেসার পাম্প। বহির্গমনে বিশেষ পদ্ধতিতে ‘ছাঁকনি’ স্থাপন করা থাকবে। যাতে ময়লা-আবর্জনা আটকে থাকবে আর পানি নদী-খালে পতিত হবে, বলেন তিনি।

কথা হলো প্রেসার পাম্প ও সেন্সর চালু রাখতে বিদ্যুৎ কোথায় পাব, আত্মজিজ্ঞাসা করে তিনি বলেন, এর সহজ উত্তর হচ্ছে, পুরো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে অবশ্যই সৌর প্যানেল স্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া প্রেসার পাম্পের জন্য পানি সরবারহ করতে হবে নদী-খালের তলদেশ থেকে পাইপের মাধ্যমে সমান গভীরতার কূপে পানি নিয়ে।

তার মতে, একটি শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না হলে সেই শহরটি দিনে দিনে বসবাসের উপযোগিতা হারায়। বিশ্বায়নের যুগে মানুষের ব্যস্ততা ও কাজের পরিধি বেড়েছে। এই সময়ে শ্রমিক দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করা অগ্রসরমাণ কোনো প্রক্রিয়া নয়। বরংছ শহরের আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিচ্ছে।

কীভাবে ও কেন অটো ড্রেন ক্লিনার চিন্তার শুরু, জানতে চাইলে ওবায়েদুল ইসলাম বলেন, লেখাপড়ার সুবাদে আমি খুলনা শহরে দীর্ঘদিন থেকেছি। সেখানে দেখেছি নগর কর্তৃপক্ষ শ্রমিক দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করায়। শ্রমিকরা ড্রেনের ময়লা তুলে হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের সামনে সুবিধামতো স্থানে সড়কের ওপরেই রাখেন। এতে প্রচুর রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ে শহরে। এসব নোংরা-আবর্জনায় যেসব মাছি বসে, সেগুলো উড়ে গিয়ে যে কারও প্লেটে বসে রোগের সংক্রমণ ঘটাতে পারে। নগর কর্তৃপক্ষ ভালো কাজ করলেও সেকেলে পদ্ধতিতে নগর পরিষ্কার করায় নগরবাসীর উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়।

বছরখানেক আগে একদিন দেখি ড্রেনের ময়লা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তুলে শহরের রাস্তায় উন্মুক্ত স্থানে রাখছেন। সেই পথ দিয়ে রিকশায় করে এক যাত্রী যাচ্ছিলেন। তিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পড়ে গেলেন ময়লার মধ্যে। তখন থেকে চিন্তা এল ড্রেন ব্যবস্থা কীভাবে আধুনিকায়ন করা যায়।

ওবায়েদুল বলেন, করোনা আমার জন্য একধরনের ভালো সময়, কারণ এই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। একাডেমিক লেখাপড়ার চাপ ছিল না। দিনে দিনে অটো ড্রেন ক্লিনার নিয়ে চিন্তার ও কাজের ফুরসত পেয়েছি।

এসবের পৃষ্ঠপোষকতা কীভাবে হলো, বললেন মামার সহযোগিতার কথা, আমার বাবার পরিচয় নেই এবং নিজের কোনো বাড়ি নেই। থাকি মামার বাড়িতে। আমার জন্মের পর মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আমার মা আমাকে নিয়ে এসে ওঠেন মামার বাড়িতে। আমার লেখাপড়া সবকিছুর ভরণপোষণ দিয়েছেন মামা। তিনি এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আমাকে সাহস ও অর্থ দিয়েছেন।

এক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে অটো ড্রেন ক্লিনার প্রযুক্তি উন্নতির জন্য কাজ করছি। এতে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে আমার। আমি বাবুগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কারিগরি বিভাগের জেনারেল মেকানিকস ট্রেড থেকে এসএসসি ভোকেশনাল এবং খুলনার ম্যানগ্রোভ ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ডিপ্লোমা ইন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছি।

ওবায়েদুল ইসলামের মামা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আবদুল জলিল শরীফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাগনে অনেক পরিশ্রম ও গবেষণা করে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। আমি মনে করি এটি ব্যবহার করলে শহর পরিষ্কার রাখতে জনবলের দরকার হবে না। অর্থ বাঁচবে এবং পরিচ্ছন্ন থাকবে শহর। তিনি ওবায়েদুল ইসলামের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য নগর কর্তৃপক্ষকে বিবেচনা আহ্বান জানান।

ওবায়েদুল ইসলামের মা ছালেহা বেগম বলেন, আমার একটিমাত্র ছেলে। খুব পরিশ্রম করে লেখাপড়া শিখিয়েছি। আমার ইচ্ছা যেন আমার ছেলে দেশবাসীর সেবা করতে পারে। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারে। সরকারের কাছে তিনি সাহায্যের আবেদন করে বলেন, তার ছেলের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি উপযুক্ত কি না, তা বিবেচনা করে দেখুক সরকার।

বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমীনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওবায়েদুল ইসলামের অটো ড্রেন ক্লিনার প্রযুক্তি সর্ম্পকে ইতিমধ্যে আমি জেনেছি। তার বাসা মাধবপাশা ইউনিয়নে। আমি সেখানকার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি এই তরুণ উদ্ভাবককে অফিসে নিয়ে আসার জন্য।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন সব সময় উদ্ভাবক, উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করে থাকে। সব ধরনের সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। ওবায়েদুল ইসলামের অটো ড্রেন ক্লিনার নিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) স্যারের সঙ্গে আলাপ করে প্রণোদনার ব্যবস্থা করব।

এনএ