রোগীর চাপ নেই। নেই সেবা না পাওয়ার অভিযোগ। চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্য স্টাফরা আছে, তবে সংখ্যায় জনবল কম। জুনিয়র কনসালটেন্ট পদটি তিন বছর ধরে শূন্য। পাঁচ বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে এক্স-রে মেশিন। জরাজীর্ণ ভবনে রয়েছে ফাটল আতঙ্ক।  স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, খসে পড়ছে পলেস্তারা। রোগীদের বিছানা থেকে টয়লেট, বাথরুম সবই অপরিচ্ছন্ন। এ রকম নোংরা পরিবেশে কোনো রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে রংপুর বক্ষব্যাধি হাসপাতালটি।

ষাটের দশকে নির্মিত এই হাসপাতালটির নানা সমস্যায় উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরাও। আর রোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন, নিরুপায় হয়েই এখানে চিকিৎসা নিতে আসতে হয়। তানাহলে কেউই আসত না ভুতুড়ে এই হাসপাতালে।

সোমবার (৩১ মে) দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে হাসপাতালজুড়ে। চিকিৎসক সংকট আর দুর্বল অবকাঠামোর কারণে হাসপাতালটি যেন নিজেই রোগাক্রান্ত। হাসপাতালের নোংরা পরিবেশে যত্রতত্র পড়ে আছে রোগীদের বেডগুলো। শৌচাগারও ব্যবহারের অনুপযোগী। স্যাঁতসেঁতে দেয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। মরিচা পড়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে প্রয়োজনীয় আসবাসপত্র। মাঠে থাকা টিউবওয়েলটিও নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডসহ একটি টয়লেট ও বাথরুমের সংস্কার কাজ চলছে।

নষ্ট হয়ে পড়ে আছে এক্স-রে মেশিন

এই হাসপাতালের পাশেই রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য বক্ষব্যাধি ক্লিনিক। সেখানকার এক্স-রে মেশিনটি পাঁচ বছর ধরে অচল। নেই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। মাত্র একজন চিকিৎসক আর দশজন স্টাফ দিয়ে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। এ ছাড়া জনবল কম থাকায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক থেকে দুইজন ও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি হতে আরও দুইজন সেখানে কাজ করছেন। যেন হাসপাতালের মতোই এই  ক্লিনিকেরও বেহাল দশা।

একটি জিন এক্সপার্ট মেশিন দিয়ে রোগীদের কফ পরীক্ষা করা হয়। দুতলা বিশিষ্ট এই ক্লিনিকে দশটি কক্ষ রয়েছে। পাঁচটি টয়লেটের তিনটিই ব্যবহার অনুপযোগী। দীর্ঘ দিনের পুরাতন দরজা-জানালার অবস্থা এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম। ক্লিনিকের পেছনের দেয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। কর্তৃপক্ষ বক্ষব্যাধি ক্লিনিকটি সংস্কারের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে চিঠি দিয়ে অবগত করছেন।

জানা গেছে, বর্তমান রংপুর নগরের তাজহাটে ১৯৬৫ সালে যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বক্ষব্যাধি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এক তলা একটি ভবনের ছয়টি কক্ষে চলছে হাসপাতালের চিকিৎসা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। এর মধ্যে একটি নারী ও দুটি পুরুষ ওয়ার্ড রয়েছে। 

অন্য তিনটি কক্ষে চিকৎসক, কর্মচারীদের বসার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলে। ২০ শয্যার এই হাসপাতালে চারটি নারী বেড ও ১৬টি পুরুষ বেডের ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে সেখানে দুইজন চিকিৎসক ও ১০ জন কর্মচারী দায়িত্ব পালন করছেন। এদের মধ্যে চিকিৎসক ছাড়াও তিনজন সিনিয়র স্টাফ নার্স, সহকারী নার্স তিনজন, ওয়ার্ডবয় দুইজন, বাবুর্চি দুইজন এবং একজন ফার্মাসিস্ট রয়েছেন।

ফাঁকা পড়ে আছে নারী রোগীদের কক্ষটি 

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের ভেতরে পুরুষ ওয়ার্ডে টাইলস লাগানোসহ ছোটখাট সংস্কার কাজ করানো হচ্ছে। সেখানে খাতাকলমে ছয়জন রোগী ভর্তি থাকলেও তাদের কাউকে বেডে থাকতে দেখা যায়নি। বরং ওয়ার্ডের ভেতর থেকে বেডগুলো বাইরে বের করে রাখা হয়েছে। দেখা মেলেনি কথা বলার মতো দায়িত্বরত চিকিৎসক বা অন্য কাউকে।

হাসপাতালের দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. শামছুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগের মতো এখন রোগীর চাপ নেই। এখন মাসে তিন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন রোগী ভর্তি হয়। বর্তমানে চারজন পুরুষ ও দুই নারী রোগী ভর্তি রয়েছেন। একেকজন রোগী এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা সেবা নেন। সংস্কার কাজ শুরু হওয়াতে হাসপাতালের নিকটবর্তী রোগীরা প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে বাসায় চলে গেছেন। তবে তারা হাসপাতালের কাছাকাছি হওয়াতে যখন ইচ্ছে আবার চলেও আসেন।

তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটির সংস্কার হয়নি। এ কারণে দেয়াল স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে পলেস্তারাও খসে পড়ে। এক সপ্তাহ আগে পুরুষ ওয়ার্ডের মেঝেতে টাইলস বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া একটি টয়লেট ও বাথরুম ছাড়া কিছু দেয়ালের পলেস্তারা সংস্কার করা হচ্ছে। কিছু কক্ষ দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে থাকায় সেগুলো এখন তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছে।

একজন চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা

রোগী ভর্তির ফাইলে ছয়জনের নাম, পরিচয় ও ভর্তির তারিখ জানা গেছে। এদের মধ্যে কেউ জানুয়ারি মাসে, আবার কেউ ভর্তি হয়েছেন মার্চে। ছয় রোগীর চারজনই হাসপাতাল সংলগ্ন উত্তর বাবুপাড়া, তাজহাট বাবুপাড়া, মাহিগঞ্জ রাজবাড়ী এলাকার বাসিন্দা। এদের মধ্যে মুঠোফোনে গোপাল মহন্ত নামে এক যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, তার বাড়ি তাজহাট রাজবাড়ী এলাকাতে হওয়ায় তিনি হাসপাতালে থাকেন না। বেশির ভাগ সময় ওষুধ লাগলে হাসপাতালে যান। চিকিৎসক সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা এবং হাসপাতালে থাকার মতো পরিবেশ নেই বললেই চলে। বিকেলের পর হাসপাতালে ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়।

হাসপাতাল সংলগ্ন স্থানীয় এক দোকানদার ঢাকা পোস্টকে নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, হাসপাতালটিতে আগের মতো রোগী থাকে না। চিকিৎসকেরাও নিয়মিত আসেন না। শুধু জনবল সংকটই নয়, সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকে না। রোগীদের বেশির ভাগ সময় বাইরে গিয়ে এক্স-রেসহ অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ক্লিনিকে গিয়ে রোগীদের উপস্থিতি চোখে পড়ে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরামর্শ নিতে চিকিৎসকের দারস্ত হয়েছেন রোগীরা। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত রোগী দেখেন একজন চিকিৎসক। রংপুর ছাড়াও মাঝে মধ্যে দিনাজপুর, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও জেলা থেকেও যক্ষ্মার চিকিৎসা নিতে রোগীরা এই ক্লিনিকে আসেন। খুব বেশি অসুস্থ হলে ক্লিনিক থেকে ভর্তি করে রোগীদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।

পুরুষ ওয়ার্ডের বাইরে পড়ে আছে বেড

ক্লিনিকে আসা জুথি আকতার নামে এক রোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ কাশি হচ্ছে। অসুস্থতা একটু বেশি মনে হওয়ায় ডাক্তার দেখাতে এসেছি। অনেকক্ষণ ধরে সিরিয়ালে আছি। তবে একজন ডাক্তার দিয়ে এতগুলো রোগী দেখানোর কারণে সবাইকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ক্লিনিকে ডাক্তারসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানো জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেখানে রোগী দেখতে ব্যস্ত থাকা চিকিৎসক আব্দুর রউফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন চিকিৎসকের পক্ষে প্রতিদিন চার ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৫০ রোগী দেখা ও প্রেসক্রিপশন করা কষ্টকর ব্যাপার। ক্লিনিকে জনবল সংকট রয়েছে। এ কারণে হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে সমন্বয় করে ক্লিনিকে রোগী দেখা হয়।

বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের মেডিকেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মেশকাতুল আবেদ ঢাকা পোস্টকে জানান, হাসপাতালের মতো ক্লিনিকেরও অবকাঠামো খুব দুর্বল। অনেক আগে নির্মিত ভবনটির সংস্কার হয়নি। মাস তিনেক আগে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে অফিস কক্ষ রং করা হয়েছে।

ব্র্যাক থেকে এই ক্লিনিকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) হিসেবে দায়িত্বে থাকা গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে জানান, জনবল সংকট থাকার কারণে তিন বছর ধরে ব্র্যাক থেকে সেখানে দুইজন সার্ভিস দিচ্ছেন। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থাকলেও রোগীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য উন্নত মেশিন ও ল্যাবরেটরি নেই। ক্লিনিকের ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন নষ্ট থাকার কারণে রোগীদের বাইরে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

ক্লিনিকের অফিস সহকারী রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৫ সাল থেকে এক্স-রে মেশিন বন্ধ রয়েছে। মেশিনটির অনেক সমস্যা ছিল। কিছুদিন আগে কিছু মেরামত কাজ করা হয়েছে। আলাদা একটি কক্ষ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমাদের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নেই। আশা করা হচ্ছে, খুব শিগগির এক্স-রে মেশিনটি পুরোপুরি মেরামত করা হবে। 

ক্লিনিক ও হাসপাতালটির সংস্কারের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার রায়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই হাসপাতাল ভবনটি অনেক পুরোনো। এ কারণে জীর্ণদশা হয়েছে। ভবনটি সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতর ও গণপূর্ত বিভাগকে জানানো হয়েছিল। সম্প্রতি ক্লিনিকের সংস্কার কাজের জন্য বাজেট পাওয়া গেছে। জুনের মধ্যেই সংস্কার কাজ শেষ হবে। গণপূর্ত বিভাগ এসব দেখাশুনা করবে।

এ ব্যাপারে রংপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ্ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংস্কার কাজের জন্য সম্প্রতি দরপত্র আহ্বান সম্পন্ন হয়েছে। খুব শিগগিরই তিনটি কাজের চুক্তি সম্পাদন করা হবে। রং করা, পানির লাইন সংযোজন, টাইলস পরিবর্তনসহ কিছু সংস্কার কাজ করতে বাকি রয়েছে। তবে এসব করতে বেশি দিন সময় লাগবে না। অর্থবছর জুন মাসের মধ্যে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।

এসপি