চীনের প্রস্তাবিত হাসপাতাল ঘিরে তিস্তাপাড়ে নতুন সম্ভাবনা
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে চলেছে চীন। এরই ধারাবাহিকতায় দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বড় ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দেশটি। এর অংশ হিসেবে রংপুরে এক হাজার শয্যার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে চীন। উপহারের এই হাসপাতাল ঘিরে স্বপ্ন বুনছে রংপুর বিভাগের তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা।
বিশেষায়িত আধুনিক এ হাসপাতালটি নির্মাণ হলে তিস্তা নদী বেষ্টিত উত্তরের পাঁচ জেলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা খাতে আমূল পরিবর্তন আসবে। পাশাপাশি ভারত নির্ভরতা কমবে বলে মনে করছেন সচেতনরা। এ কারণে তিস্তা নদী বেষ্টিত ৫ জেলার মানুষ হাসপাতালটি নিজ জেলায় নিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোর দাবি তুলেছেন। অনেক জেলায় মানববন্ধন-সমাবেশ কর্মসূচিও পালিত হয়ে আসছে।
বিজ্ঞাপন
এ ধারাবাহিকতায় শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে রংপুরের তিস্তা নদীর তীরবর্তী গঙ্গাচড়ায় চীনের অর্থায়নে এক হাজার শয্যার প্রস্তাবিত উপহারের হাসপাতালটি নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন হাজারো মানুষ। তিস্তা উন্নয়ন ফোরামের ব্যানারে গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর তিস্তা সেতু এলাকায় অনুষ্ঠিত এ মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ জানিয়ে অংশ নেয় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও পেশাজীবী সংগঠনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হওয়া এ মানববন্ধনে কয়েক শতাধিক শিশুর অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এসময় দাবির পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন প্রদর্শন করে তারা। আয়োজকরা জানান, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিশুদের এই প্রতীকি অংশগ্রহণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বিজ্ঞাপন
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, প্রস্তাবিত হাসপাতালটি বাস্তবায়িত হলে রংপুরসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। চিকিৎসাসেবায় স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও উপকৃত হবেন। একটি উন্নত হাসপাতাল শুধু চিকিৎসার কেন্দ্র নয়, এটি হবে উত্তর জনপদে জ্ঞান, গবেষণা ও মানবিকতার মিলনমঞ্চ।
গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় উচ্চতর পরিষদ সদস্য হানিফ খান সজিব বলেন, ভারত যখন চিকিৎসা ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে, তখন আমাদের দেশে নিজস্বভাবে বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। চীনের উপহারের হাসপাতালটি হবে আত্মনির্ভর বাংলাদেশের একটি মাইলফলক।
জামায়াতে ইসলামীর গঙ্গাচড়া উপজেলা আমির মাওলানা নায়েবুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হাসপাতাল বাস্তবায়িত হলে চরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষ উন্নত চিকিৎসাসেবা পাবে। ইসলামের দৃষ্টিতেও এটি মানবকল্যাণের একটি বড় উদাহরণ। আমরা এর পক্ষে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি চাঁদ সরকার বলেন, দল-মত নির্বিশেষে আমরা এই প্রকল্পের পক্ষে। এটি কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি জনগণের অধিকার। উন্নত চিকিৎসাসেবার জন্য এই হাসপাতাল অত্যাবশ্যক।
লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, তিস্তার চরাঞ্চলে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল স্থাপন এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এখানকার স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।
এদিকে প্রস্তাবিত স্থানটি গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর তিস্তা সেতু সংলগ্ন চর কলাগাছি এলাকা। এখানে প্রায় ২৯ একর খালি জমি রয়েছে, যা হাসপাতালের মূল ভবন, হেলিপ্যাড, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আবাসন ও গবেষণাগার নির্মাণের জন্য উপযুক্ত। সবুজেঘেরা শান্ত পরিবেশ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে সহায়ক হবে বলে জানান আয়োজকেরা।
গত ১৫ এপ্রিল গঙ্গাচড়া উপজেলার চর কলাগাছি এলাকা পরিদর্শন করেন হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প প্রতিনিধি দল। এ সময় তারা চর কলাগাছির ১০০ একর খাসজমির মধ্যে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ২০ একর জায়গা পরিদর্শন করেন। তবে এখনো চীনা কর্তৃপক্ষ হাসপাতালটি নির্মাণের জন্য জায়গা নির্বাচন চূড়ান্ত করেনি।
রাজনীতিবিদ, সংগঠক ও পেশাজীবী মানুষেরা বলছেন, রংপুর বিভাগে স্বনামধন্য চিকিৎসক থাকলেও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি পরিচালনার অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান নেই। ফলে চিকিৎসার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে রোগী ও স্বজনদের মনে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবছর চিকিৎসার জন্য এই বিভাগের বিপুল পরিমাণ মানুষ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যান। ছোট-বড় রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেন তারা।
গণঅভ্যুত্থানের পর রংপুরে অবস্থিত ভিসা সেন্টার বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। ফলে ভারতের নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া রোগীরা বিপাকে পড়েন। অনেকের মাঝপথে থমকে যায় চিকিৎসা। একারণে চীনের অর্থায়নে এক হাজার শয্যার প্রস্তাবিত হাসপাতালটি ঘিরে এখন সবাই নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক ইমরান আহমেদ বলেন, বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য ভারত ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। আর তখনই আমাদের জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। চীন সরকার বাংলাদেশিদের চিকিৎসাসেবার জন্য নানা সুযোগ তৈরি করেছে।
‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’- সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, তিস্তাপাড়ের মানুষ উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বরাবরই বঞ্ছিত ছিল। শুধু তাই নয় বলতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকারও হয়েছে। তাই তিস্তাপাড়েই হাসপাতাল নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা উচিত।
রংপুরে জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল বলেন, আমরা গঙ্গাচড়ায় আনঅফিসিয়ালি একটি জায়গা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা উপস্থিত ছিলেন। কোথায় হাসপাতাল নির্মাণ হবে সেই বিষয়ে আর কিছুদিন পরেই খোলাসা হবে।
এদিকে চীনের প্রস্তাবিত হাসপাতালটি শহীদ আবু সাঈদের স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান পীরগঞ্জে স্থাপনের জন্য দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। দাবি আদায়ে ‘পীরগঞ্জের সর্বস্তরের জনগণ’ সংবলিত ব্যানারে শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) বিকেলে পীরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে গণজমায়েত ও মানববন্ধন করা হয়।
এ মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন শহীদ আবু সাঈদ ফাউন্ডেশনের সভাপতি রমজান আলী। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- রংপুর জেলা বিএনপির আহবায়ক সাইফুল ইসলাম, জেলা জামায়াতে ইসলামী মজলিশে শুরা ও কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা নুরুল আমিন, উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাহমুদুন নবী পলাশ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুজ্জামান শাহীন, ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আবু হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর উপজেলা আমীর মাওলানা মিজানুর রহমান, সাবেক আমীর অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, এনসিপি জেলা সংগঠক মাসুম বিল্লাহ প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ। যার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠলে ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। পতন হয় দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসন ব্যবস্থার। এর মধ্যদিয়ে মানুষ বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
আন্দোলনকারীরা বলেন, বিগত ১৬ বছরে রংপুর বিভিন্ন ভাবে পিছিয়ে ছিল। বৈষম্যের শিকার পীরগঞ্জ উপজেলার মানুষ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পায়নি। ঢাকা থেকে বিভাগীয় শহর রংপুরের প্রবেশদ্বার পীরগঞ্জ। এর আশপাশের অন্যান্য জেলা ও উপজেলার মানুষও চায় চীনের প্রস্তাবিত এক হাজার শয্যার হাসপাতালটি শহীদ আবু সাঈদের উপজেলার মানুষকে উপহার হিসেবে দেয়া হোক। আবু সাঈদের স্মৃতিবিজড়িত পীরগঞ্জে চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল নির্মাণে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান বক্তারা।
প্রসঙ্গত, গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘হাসপাতালটি তিস্তা প্রকল্প এলাকার কাছে নির্মিত হবে।’ এতে বোঝা যাচ্ছে তিস্তা নদীবেষ্টিত এলাকাতে হচ্ছে হাসপাতালটি। ইতোমধ্যে তিস্তাপাড়ের কয়েকটি স্থান পরিদর্শনও করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএএস