‘হাজিরহাট থানার নামটা আমি কয়েকবার শুনেছি। আমি রংপুরে খুব বেশি দিনের মানুষ নই। হাজিরহাট থানা বা তার এলাকা এখনো আমি চিনি না। এটা উত্তরে না দক্ষিণে, পূর্বে না পশ্চিমে আমি চিনি না। সেই এলাকায় একটা হত্যাকাণ্ড হয়েছে অথবা মৃত্যু হয়েছে কারও সেই মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমি আশ্চর্য হলাম হাজিরহাট থানার মামলায় পুলিশ আমাকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে তুলে আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়।’

মঙ্গলবার (২৪ জুন) দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) কবি হেয়াত মামুদ ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হক। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া মুদি দোকানি ছমেছ উদ্দিন হত্যা মামলায় জামিনে মুক্ত হওয়ার দুইদিন পর তিনি এই সংবাদ সম্মেলন করেন।

মাহমুদুল হক দাবি করেন, ‎একটি সংঘবদ্ধ চক্রের পরিকল্পনায় তাকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। চক্রটি তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারাই মামলা করাচ্ছে। হাজিরহাট থানায় যে মামলায় তার নামে দেওয়া হয়েছে, সেই ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছে। তাকে তিনি চেনেন না, এমনকি ঘটনাস্থল কিংবা হাজিরহাট থানা এলাকাও তার অজানা। হয়তো পুলিশ কমিশনারের গ্রিন সিগন্যালে তাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৯ সালে আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। ২০২০ সালের দিকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবিরোধী একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে যুক্ত হই। তৎকালীন উপাচার্যের বিরুদ্ধে ৭৯০ পৃষ্ঠার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনায় গোল বৃত্তকে চারকোনা বানানোর বিষয়ে আমি একটি মামলা করি। এর ফলে আমার পক্ষে-বিপক্ষে কিছু গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে যায়। আমি অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার কিছু বিপক্ষ গ্রুপ দাঁড়িয়েছে গেছে এই বিশ্ববিদ্যলেয়ে।

গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে ‎‎মাহমুদুল হক বলেন, ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রোগ্রাম শেষে আমি বাসায় যাই। তখন আমার তের বছরের ছেলে ও আমি বাসায় ছিলাম। আমার পরিবার রাজশাহীতে ছিল। হঠাৎ সাদা পোশাক ও ইউনিফর্ম পরিহিত কিছু পুলিশ সদস্য ওসিসহ আমার বাসায় আসে। তারা আমাকে ছমেছ উদ্দিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে। আমি ওই মামলার সবশেষ ৫৪ নম্বর আসামি। আমাকে সরাসরি কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয়। আমি অবাক হয়ে যাই, কারণ মামলা ছিল হাজিরহাট থানায়, অথচ আমাকে কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয়। সেখানে কিছু কাগজপত্র তৈরি করা হয়। এরপর দ্রুত আমাকে আদালতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড শুনানি শেষে জেলহাজতে পাঠানো হয়। 

তিনি আরও বলেন, এর আগেও অটোচালক মানিক হত্যা মামলায় আমাকে হয়রানি করা হয়। সেখানে আমি ছিলাম ১৯ নম্বর আসামি। কেন এসব হয়রানিমূলক মামলা করা হচ্ছে, তা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে অধিকার নিয়ে কথা বলেছি, মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। এসব কারণেই একটি সংঘবদ্ধ চক্র আমার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারাই এসব মামলা করাচ্ছে এবং বাদীকে প্রভাবিত করছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে সরাতে, আমার পরিবারকে হেয় করতে এসব মামলা করা হয়েছে।

এ সময় হয়রানি বন্ধ করাসহ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং এসবের নেপথ্যে থাকা জড়িতদের শনাক্তে দুটি দাবি তুলে ধরেন শিক্ষক মাহমুদুল হক। দাবিগুলো হলো- দুটি মামলায় তার নাম প্রত্যাহার করতে হবে। হাজিরহাট থানার ওসিকে বরখাস্ত করে আইনের আওতায় এনে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে এবং কাদের ইন্ধনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) ছমেছ উদ্দিন হত্যা মামলায় শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানান। টানা তিন দিন জেলহাজতে থাকার পর গত রোববার জামিনে মুক্ত হন শিক্ষক মাহমুদুল হক। একই দিনে হাজিরহাট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল আল মামুনকে বদলি করা হয়।

 কবরে নতুন সাইনবোর্ড

রংপুরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়ায় পালিয়ে যাওয়ার সময় হার্ট অ্যাটাকে মুদি দোকানদার ছমেছ উদ্দিন মারা যাওয়ার ১০ মাস পর দায়ের করা ‘হত্যা মামলা’ নিয়ে বিতর্ক থামছেই না। নিহতের পরিবারের বক্তব্য, মামলার এজাহারে গরমিল তথ্য আর পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এরই মধ্যে তদন্ত ছাড়াই এজাহারভুক্ত সর্বশেষ আসামি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করে তড়িঘড়ি কারাগারে পাঠানো হয়।

এনিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সমালোচনার মুখে রোববার (২২ জুন) ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও হাজিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আল মামুন শাহকে মহানগর ডিবির পরিদর্শক হিসেবে বদলি করা হয়। একই দিনে টানা তিন দিন জেলহাজতে থাকার পর জামিনে মুক্ত হন শিক্ষক মাহমুদুল হক।

এসব নিয়ে বিতর্কের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার ছমেছ উদ্দিনের কবরে টাঙানো সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে ‘হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু’ হয়েছে লেখা আগের সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একই আদলে টাঙানো নতুন সাইনবোর্ডে এখন নেই ‘হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু’ লেখাটি।

নতুন করে একই স্থানে ঝুলানো সাইনবোর্ডটিতে মামলার এজাহারের সাথে মিল রেখে বলা হয়েছে- ‘গত ০২ আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার দোসরেরা এবং পুলিশের একটি দলের আঘাতে রক্তাক্ত যখম হয় এবং ঘটনাস্থল থেকে প্রাইম মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার ছমেছ উদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করে।

আর ১০ মাস আগে টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা ছিল- ‘জাতীয় বীর ছমেছ উদ্দিন, গত ০২ আগস্ট ২০২৪, পুলিশ বিভাগের একটি দল তার বাড়িতে প্রবেশ করলে তিনি পুলিশ দেখে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে যায় এবং তিনি সেখানেই স্টক করে মারা যায় তা নিশ্চিত করে প্রাইম মেডিকেল কলেজের ডাক্তার।’

নজিরেরহাট বাগানবাড়ি জামে মসজিদ ও কবরস্থানের দায়িত্বে থাকা হাফেজ মাওলানা মো. মাহমুদুল হক লেবু জানান, সোমবার দুপুরে ছমেছ উদ্দিনের কবরে টাঙানো নতুন সাইনবোর্ডটি তার চোখে পড়ে। আগের ডিজাইনে সাইনবোর্ডটি ঠিক থাকলেও শুধু লেখার পরিবর্তন হয়েছে। কে বা কারা এটি করেছে, তা তিনি জানেন না। কারণ কবরস্থান কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এটি টাঙানো হয়েছে।  

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর