মৃত্যুর পর চলে গেছে দশ মাস। কিন্তু এখনও কান্না থামেনি মো. সিরাজুল ইসলাম ব্যাপারীর মা শিরিন আক্তারের। তার সারাদিন কেটে যায় নানা ব্যস্ততায়। কিন্তু চারদিক আঁধার করে যখন রাত নামে তখন বিশাল এক শূন্যতা তার বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে। তখন ডুকরে কান্না ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার বাড্ডায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিরাজুল ইসলাম (২৮)।

সিরাজুল ফরিদপুর সদরের ডিক্রির চর ইউনিয়নের তায়জদ্দিন মুন্সীর ডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম (৬৯) ও শিরিন আক্তারের (৪৫) ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। সিরাজুল বিবাহিত, তবে তার কোনো সন্তান ছিল না। সাড়ে তিন শতাংশ জায়গায় একটি সেমিপাকা (টিনের বেড়া) ঘরে বসবাস করেন সিরাজুলের মা-বাবা।  ঢাকার বাড্ডা এলাকায় একটি রিকশার গ্যারেজের যৌথ মালিক ছিলেন তিনি। তবে তার ব্যবসায়ীক সহযোগী টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় মৃত্যুর আগে মাথায় এক বোঝা ঋণ রেখে মারা যান সিরাজুল।

সিরাজুলের মা শিরিন আক্তার বলেন, মা হয়ে ছেলের এমন মৃত্যু আমি মানতে পারি না। দিন আর রাত আলাদা বুঝি না এখন, সবই এক রকম আঁধার হয়ে গেছে।

শিরিন আক্তার জানান, সিরাজুল ছোটবেলা থেকে ছিল শান্ত, ভদ্র আর স্বপ্নবান। পড়ালেখার সুযোগ হয়নি, কিন্তু চেষ্টার ঘাটতি ছিল না। তিন বছর আগে ঢাকায় শুরু করে ছোট একটি রিকশা গ্যারেজের ব্যবসা। দেনা হয়ে গিয়েছিল, তবু বলতো মা, একটু সময় দাও, ঠিক হয়ে যাবে। সেই ‘ঠিক হওয়া’ আর হইলো না।

তিনি বলেন, ছেলেকে কবর দিয়েছি ফরিদপুর শহরের ধলার মোড়ের পাশে। মাঝে মধ্যে সেখানে গিয়ে বসি। মাটির নিচে শুয়ে আছে সে, আর আমি শুধু শুনি নীরব একটা ডাক- মা।

বাবা শফিকুল ইসলাম চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ছেলে যখন ঢাকায় গ্যারেজ খুললো, মনে মনে ভেবেছিলাম- এই বুঝি ঘুরে দাঁড়াবে। দিন ফিরবে। এখন প্রতিদিন ঘুমাতে গেলেই মনে হয় বুকের ভেতর কিছু একটা ভেঙে যাচ্ছে। একটা রাতও ওকে মনে করা ছাড়া থাকতে পারি না। কান্না ছাড়া ঘুমাতে পারি না। যখন ওর কবরের পাশে বসি, কান্না ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। কত কথা মনে আসে, কত স্মৃতি ভাসে। কিন্তু আমার বাজান তো আর ফিরবে না।

একটি পরিবারের সমস্ত স্বপ্ন কি একজন মানুষের বুকেই থমকে থাকে?

ফরিদপুরের সেই ছোট ঘরের ভেতরটুকু চুপচাপ, বলে দেয়- হ্যাঁ, থাকতেও পারে। কারণ সেই ঘরে আজ আর নেই সিরাজুল ব্যাপারী, নেই হাসি, নেই ভরসা, শুধু নিঃশব্দ কান্না আর এক মায়ের আর্তনাদ।

সিরাজুল বিয়ে করেছিলেন দিলরুবা বেগম নামে এক তরুণীকে। ভালোবাসায় গড়া ঘরে সন্তান আসেনি, তবুও তারা ছিলেন পরিপূর্ণ। সেই দিলরুবা এখন আছেন বাবার বাড়িতে, নিঃসঙ্গ বিধবা।

ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করা নিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছে অসহায় এই পরিবারটি। হাসিবুল হাসান লাবলু নামে এক প্রতারক সিরাজুলের বাবা ও মাকে না জানিয়ে গত ২৯ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতে মামলা করেন সিরাজুলকে হত্যার দায়ে। ১ সেপ্টেম্বর মামলাটি রুজু করে বাড্ডা থানা। মামলায় উল্লেখ আছে ১২০ জনের নাম, অজ্ঞাতনামা আরও তিন শতাধিক। অভিযুক্তদের তালিকায় দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত রয়েছেন।

সিরাজুলের বাবা বলেন, ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় মামলার ব্যাপারে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি। এক প্রতারক যাকে আমি কোনোদিন দেখিনি, চিনি না, জানি না, সে বাদী হয়ে চাঁদাবাজি করার জন্য মামলা করেছে। আমি বুঝে গেছি, আমার ছেলে হত্যার প্রকৃত বিচার আমি পাবো না।

পরিবারের সদস্যদেরকে সরকার দিয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। এর অর্ধেক নিয়েছেন স্ত্রী, বাকিটুকু মা-বাবা। জামায়াতে ইসলামি দিয়েছে আড়াই লাখ টাকা, বিএনপি দিয়েছে পঞ্চাশ হাজার। কিন্তু এসব দিয়ে কি ফিরে পাওয়া যায় একটা প্রাণ? বড় ছেলের দুই বাচ্চাসহ ঢাকায় আলাদা সংসার। ছোট ছেলের অনুপস্থিতিতে মা শিরিন আক্তার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মাসিক চার হাজার ৮০০ টাকার বিনিময়ে আয়া পদে চাকরি করছেন। স্বামী শফিকুল বয়সের ভারে চলাফেরা করতে পারেন না। এই চার হাজার ৮০০ টাকায় চলতে হচ্ছে নিহত শহীদ সিরাজুলের মা-বাবা দুজনকেই।

সিরাজুলের ভাই শাহজাহান ব্যাপারী বলেন, ভাইটা আমার বড় স্বপ্ন দেখত। বলত, গ্যারেজটা জমবে একদিন। এখন গ্যারেজ ফাঁকা, আর ভাই আমার কবরে। কয়েকটি বুলেট এসে মৃত্যু ঘটালো এক তরুণের স্বপ্নের।

প্রসঙ্গত, জুলাই অভ্যুত্থানে ফরিদপুরের মোট আটজন মারা যান। এরমধ্যে একজন ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় শামসু মোল্লা (৫৫) নামে একজন ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার সামনে পুলিশের গুলিতে মারা যান। বাকি সাতজনের মৃত্যু হয় ঢাকাতে।

জহির হোসেন /এমএএস