পটুয়াখালীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় কার?
বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই পটুয়াখালীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছেন, হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা। শহরের বিভিন্ন এলাকায় এডিস মশা ও লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পৌরসভা থেকে মশা নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
পটুয়াখালী শহরের চৌরাস্তা ট্রাফিক বক্সের পেছনে, পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের পাশের পরিত্যক্ত ডোবা, বাসস্ট্যান্ডের পেছনে ফেলে রাখা টায়ার, টিভি ক্লিনিক সংলগ্ন জলাশয় এবং কালিবাড়ির পরিত্যক্ত পুকুর এলাকায় এডিস মশা এবং এর লার্ভা পাওয়া গেছে। এছাড়া শহরের বদ্ধ খাল, দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করা ড্রেন ও পরিত্যক্ত জলাশয়গুলো যেন মশা জন্মের আঁতুড়ঘর।
শহরের চৌরাস্তা ট্রাফিক বক্সের পেছনে, পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের পাশের পরিত্যক্ত ডোবা, বাসস্ট্যান্ডের পেছনে ফেলে রাখা টায়ার, টিভি ক্লিনিক সংলগ্ন জলাশয় এবং কালিবাড়ির পরিত্যক্ত পুকুর এলাকায় এডিস মশা এবং এর লার্ভা পাওয়া গেছে। এছাড়া শহরের বদ্ধ খাল, দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করা ড্রেন ও পরিত্যক্ত জলাশয়গুলো যেন মশা জন্মের আঁতুড়ঘর
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পৌর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ ও কার্যকারিতা
বিজ্ঞাপন
পটুয়াখালী পৌরসভার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মশক নিধনে মোট বরাদ্দ ছিল প্রায় ১৭ লাখ টাকা। চলতি মৌসুমে ২০০০ লিটার এডাল্টিসাইড (বয়স্ক মশা নিধনে ব্যবহৃত ঔষধ) ও ১০০ লিটার লার্ভিসাইড (লার্ভা নিধনের ঔষধ) কিনতে ব্যয় হয়েছে প্রায় আট লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এছাড়া ঝোপঝাড় পরিষ্কার, শ্রমিকদের মজুরি ও ফগার মেশিনের জ্বালানি বাবদ আরও ৫৭ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডে মাত্র সাতটি সচল ফগার মেশিন রয়েছে। পাঁচটি মেশিন অচল অবস্থায় পড়ে আছে। ফগিং কার্যক্রম নিয়মিত হলেও তার বিস্তার ও সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে জনমনে রয়েছে অসন্তোষ। শহরে নিয়মিত ফগিং কার্যক্রম চলছে— পৌর কর্তৃপক্ষ এমন দাবি করলেও পৌর এলাকার ৪নং ওয়ার্ডের আরামবাগ ও মাতবার বাড়ি এলাকা, ৮নং ওয়ার্ডের মধ্য কলাতলা এবং ৭নং ওয়ার্ডের ডিসি বাংলোর পেছনের এলাকা এখনও ফগিং কার্যক্রমের আওতায় আসেনি।
গত এক মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪২ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪৮৫ জন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে ৫৭ জন ডেঙ্গু রোগী। তবে, বরগুনার পাশের উপজেলা হওয়ায় মির্জাগঞ্জে ডেঙ্গুর প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরে এই একটি উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৩২১ জন। তাদের মধ্যে ২৯৫ জন বাড়িতে ফিরেছেন
৭নং ওয়ার্ডের ডিসি বাংলোর পেছনে চপ বিক্রেতা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বিকালে যখন দোকান বসাই তখন মশার কামড়ে দাঁড়ানো যায় না। কাস্টমাররা আইসা বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। যেভাবে ডেঙ্গু বাড়তেছে, আমারই তো দোকানে বসতে ভয় লাগে। তবে, আমি এখনও এলাকায় কোনো ধরনের ফগিং কার্যক্রম দেখি নাই।’
৮নং ওয়ার্ডের মধ্য কলাতলা এলাকার গৃহিণী মোসাম্মত আসমা বেগম বলেন, ‘প্রতিবারই বর্ষাকালে ডেঙ্গুর আতঙ্কে থাকতে হয়। মশার জ্বালায় বাসায় থাকা খুবই কষ্টকর। দিনের বেলায়ও মশারি টানাইয়া থাকতে হয়। পৌরসভার লোকজন যদি একটি স্প্রে করে যাইতো, তাহলে হয়তো মশা একটু কম জ্বালাইতো।’
৯নং ওয়ার্ডের নন্দকানাই পানির ট্যাংক সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা রিপন শীল বলেন, ‘চারদিকে ঝোপঝাড় এবং নিচু জায়গাগুলোতে পানি জমে থাকায় মশা জন্মাচ্ছে অনেক। কিন্তু এখন পর্যন্ত পৌরসভা থেকে মশার কোনো স্প্রে করা হয় নাই।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সিভিল সার্জনের মতামত
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ঔষধ ছিটালেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। প্রয়োজন জনসচেতনতা, নিয়মিত পরিষ্কার অভিযান এবং বদ্ধ জলাশয় অপসারণের মতো কাঠামোগত উদ্যোগ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে পৌরসভার পক্ষ থেকে যথেষ্ট ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
পটুয়াখালী পৌর প্রশাসক জুয়েল রানা বলেন, ‘আমরা নিয়মিত ফগিং করছি এবং লার্ভা ধ্বংসে কাজ করছি। প্রতিদিন সাত থেকে আটটি ফগার মেশিন দিয়ে মশা নিধন করছি। এছাড়া আমাদের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা প্রতিটি ওয়ার্ডে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করবে। পাশাপাশি পুরো পৌর এলাকায় আমাদের মাইকিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সবার সহযোগিতায় আমরা ডেঙ্গুকে মোকাবিলা করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।’
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না হলে এবং পরিকল্পিতভাবে অভিযানের ধরন পরিবর্তন করা না হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না হলে এবং পরিকল্পিতভাবে অভিযানের ধরন পরিবর্তন করা না হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, গত এক মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪২ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪৮৫ জন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫৭ জন ডেঙ্গু রোগী। তবে, বরগুনার পাশের উপজেলা হওয়ায় মির্জাগঞ্জে ডেঙ্গুর প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরে এই একটি উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৩২১ জন। তাদের মধ্যে ২৯৫ জন বাড়িতে ফিরেছেন।
সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ খালেদুর রহমান মিয়া বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে, প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। বরাদ্দ দেওয়া অর্থের সঠিক ব্যবহার, সচল ফগার মেশিনের সংখ্যা বাড়ানো, প্রতিটি ওয়ার্ডে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি জনগণকে সম্পৃক্ত করে একটি বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা জরুরি।
এমএআর