এলিজা বিনতে এলাহী। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সন্ধানে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছেন যিনি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঘুরে ঘুরে দেখছেন, সংগ্রহ করছেন সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং তথ্য-উপাত্ত। এক কথায় যাকে বলে হেরিটেজ ট্যুরিজম। নিজেকে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন ‘ঐতিহ্য পর্যটক’ হিসেবে।

২০১৬ সালের ১৭ মে থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে প্রথম পর্বে ‘কোয়েস্ট­ : আ হেরিটেজ জার্নি অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের ৬৪ জেলা। সারাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখছেন, সংগ্রহ করেছেন তথ্য। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে কাজ করাই তার মূল ভাবনা।

এলিজা বিনতে এলাহী বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক। ইতিহাস-ঐতিহ্য আর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার খোঁজে তৃতীয়বারের মতো এসেছেন উত্তরের জেলা নীলফামারীতে। অবস্থান করছেন নীলফামারীর সৈয়দপুরে।

১৯৯৯ সালে নেপালে প্রথম বিদেশ ভ্রমণে যান তিনি। দেশের মানচিত্র ছাড়িয়ে ইতোমধ্যে ৪৯টি দেশ ঘুরেছেন তিনি। এশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দুটি তথ্যবহুল প্রকাশনা ‘এলিজা’স ট্রাভেল ডায়েরি’ ও ‘এলিজা’স ট্রাভেল ডায়েরি-২’ প্রকাশিত হয়েছে।

এলিজা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন। পরে এআইইউবি থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে এমবিএ করেন। নেদারল্যান্ডসের দি হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসে কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধীনে বাংলাদেশের হেরিটেজ ট্যুরিজমের ওপর গবেষণা করেছেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বিকাশে হেরিটেজ ট্যুরিজমের গুরুত্ব’।

কেমন চলছে এলিজার ভ্রমণ ও কর্ম, ঢাকা পোস্টকে তা জানিয়েছেন এই গুণী নারী। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহ্য পর্যটনের ওপর কিভাবে আগ্রহ তৈরি হলো সে সম্পর্কে এলিজা বলেন, আমি ১৯৯৯ সাল থেকে বিদেশ ভ্রমণ করছি। সেখান থেকেই হেরিটেজ ট্যুরিজম জিনিসটি মাথায় এসেছে। আমি বিদেশ ভ্রমণের সময় দেখেছি তারা তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়েছে, আপামর জনসাধারণকে পর্যটন শিল্পে কাজে লাগাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকাও আধুনিক জিনিসপত্র তৈরি করে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে।

এলিজা বলেন, আমাদের দেশের হাজার বছরের ইতিহাস আছে, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা আছে, ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে। আমরা শুধু বই পড়েই জেনেছি এগুলো আছে। কিন্তু এগুলো কোন জেলায় কিভাবে আছে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতেই আমার আসা। হেরিটেজ ট্যুরিজম বিকাশে আমাদের প্রতিবন্ধকতা কি কি আছে, কোন কোন জায়গায় আমরা এগিয়ে আছি এগুলো দেখতে এখানে আসা। সবচেয়ে বড় কথা তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ ট্যুরিজমের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। 

দেশের ৬৪ জেলা বেড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কেমন ছিল? এ বিষয়ে এলিজা বলেন, আমাদের দেশের সবথেকে বড় সমস্যা হলো তথ্যের অপ্রতুলতা। নীলফামারীতে এসেছি নীলকুঠি নিয়ে কাজ করতে। নীলফামারীর নাম নীলচাষকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। নীলকুঠিগুলো খুঁজতে গেলাম। কেউ কিছু বলতে পারছে না। পুরাতন স্টেশনের কাছে নীলকুঠি পাব জানতে পারলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম সেটি আসলে নীলকুঠি নয়, একটা এসডিও বাংলো। এটাও ভুল তথ্য ছিল। নীলকুঠি বলেই খুঁজতে গিয়েছিলাম। জেলা প্রশাসকের দেওয়া তথ্য মতে, ওটিও নীলকুঠি নয়।

গণপরিবহনের অপ্রতুলতা, আবাসন সমস্যা, নিরাপত্তার বিষয়, সরকারি জায়গাগুলো বাদে পর্যটকবান্ধব আবাসন সুবিধা নেই- ট্যুরিজম বিকাশের ক্ষেত্রে এগুলো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। দেশীয় পর্যটকরাই যদি নিরাপত্তা বোধ না করে তাহলে বিদেশি পর্যটকদের আমরা আকৃষ্ট করব কিভাবে? এক্ষেত্রে আপামর জনতাকে কাজ করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই আমরা দেখি, অনেকেই নিজের খালি দু’একটি ঘর ভাড়া দিচ্ছে পর্যটকদের। এখানে ট্যুরিস্ট গাইডও নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আবার এই ব্যবস্থাগুলো আছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দেশন ও ঐতিহ্য পর্যটন নিয়ে কাজ করার আগ্রহের জায়গা জানতে গিয়ে এলিজা বলেন, পর্যটনে আমার আগ্রহের কারণ বিশ্বের অনেক দেশের রাস্তাঘাট, আর্থ-সামাজিক অবস্থান আমাদের দেশের মতো। কিন্তু পর্যটন শিল্পকে তারা দারুণভাবে ব্যবহার করছে। আমরা পারছি না। আমরা পারছি না কেন এই জায়গাটা দেখতে হবে। আমাদের সমৃদ্ধির কোনো কমতি নেই। দেখার জাগার কোনো কমতি নেই। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার কোনো তালিকা নেই, আমাকে স্থানীয়দের সাহায্য নিতে হচ্ছে।

হেরিটেজ ট্যুরিজম নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে এলিজা বলেন, এ বছর জাতীয়ভাবে চা দিবস পালন হয়েছে। আমি সরকারের কাছে চাই একটা হেরিটেজ ট্যুরিজম ডে ঘোষণা করা হোক। ওই দিন প্রত্যেক জেলা তার প্রশাসনের মাধ্যমে একটা স্থাপনা দেখার উপযোগী করে তুলবে, সেটা নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাবে। ফলে প্রতি বছর দেশের ৬৪টি স্থাপনা মানুষের দেখার উপযোগী হবে। পরের বছর আরও ৬৪টি জেলা। এভাবে ৫ বছরের একটি পরিকল্পনা করে নিলে খুব ভালো হবে।

নীলফামারী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন (ব্রিটিশ বিল্ডিং) ঘুরে দেখে এলিজা বলেন, নীলফামারী সরকারি স্কুলের নতুন ভবনে ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া হোক। আর পুরাতন ভবনটা সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে টিকেট কেটে দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করে একজন কেয়ারটেকার রেখে এটাকে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। এতে করে নীলফামারীর ঐতিহ্য বাড়বে। তরুণরা গর্ববোধ করবে নিজের স্কুল নিয়ে।

ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য এলিজা বলেন, আমি একজন মা-শিক্ষক-স্ত্রী। আমি যদি নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারি সেক্ষেত্রে সবাইকে বলতে চাই, বাংলাদেশ ভ্রমণ করার জন্য একটি নিরাপদ জায়গা এবং বাংলাদেশে দেখার অনেক কিছু আছে। বাংলাদেশকে চায়ের জন্য, ক্রিকেট খেলার জন্য ব্র্যান্ডিং করা যায়। গার্মেন্টস শিল্প, সোনালি আঁশ পাট এবং হেরিটেজ ট্রাভেলিংয়ের মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব।

মৃত্যু পর্যন্ত ভ্রমণ করতে, হেরিটেজ টুরিজম বিকাশে কাজ করার পাশাপাশি এই কাজে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে চান এলিজা। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ ভ্রমণের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা সেটা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। 

এসপি