‘ওর সব জিনিসপত্র আছে, খালি ব্যাটাটা নাই। ব্যাটার (ছেলের) মুখের মা ডাক আমার এখনো কানে বাঁজে।’ বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন শহীদ আলী রায়হানের মা রোকসানার বেগম।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার মঙ্গলগ্রামে আলী রায়হানের বাড়ি। তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের কথায় আলী রায়হানের (২৮) শূন্যতা উপলব্ধি করা যায়। আলী রায়হানের থাকার ঘরটিতে এখনো তার ব্যবহারের জিনিসপত্র যত্নে সংরক্ষণ করা আছে। রায়হানের সোয়ার ঘরে ছোট ভাই রানা ও বাবা মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আসলেন মা  রুখসানা বেগম।

তিনি বলেন, ‘তার (রায়হান) খাওয়া-দাওয়া, চলা ফেরা, ডাকা সবই মনে পড়ে। রায়হানের পছন্দের খাবার ছিল হাঁসের মাংস। শাকসবজি সব খেত। কতবার ফোন দিচ্ছিনু (দিয়েছি) বাবা কখুন (কখন) আসবে বাড়িতে। আসতে চাইলে রান্নাবারা করে নিয়ে বসি থাকতু (বসে থাকতাম)। কখন আমার ব্যাটা (ছেলে) আসপি (আসবে)। অনেকদিন হলো আমি আমার ব্যাটার (ছেলের) ডাক শুনতে পাই না। ব্যাটার (ছেলের) জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি। আমার বাবা আসলে (এসে) বেশি দেরি করে না। আসলে হয়তো একদিন থ্যাকি (থেকে) চলে যায়। অন্যই (এজন্যই) আগে থ্যাকিই (থেকে) সব রেডি (প্রস্তুত) করি (করে) রাখিচ্চুনু (রাখতাম)।’

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ ব্যাটা (ছেলে) না আসে, আমি ততক্ষণ ঘাটার (পথের) দিতে তাকা (তাকিয়ে) থাকি। কখন আমার ব্যাটা (ছেলে) আসপি (আসবে)। আমার ব্যাটা (ছেলে) বাসাতে ঢুকার আগে ছুট্টু (ছোট) করে সালাম দিবি (দেবে)। তারপরে বাড়িতে ঢুকে (ঢুকে)। সালাম দিবি (দেবে) মা বলে ডাকে।

‘আমার ব্যাটার (ছেলে) তো গুলি লাগলো ৫ (আগস্ট) তারিখে। তিন তারিখে ব্যাটার (ছেলের) সঙ্গে কথা হচে (হয়েছে)। আমিই ফোন দিয়েছিলাম। ব্যাটার (ছেলে) সঙ্গে কথা হতে হতে আমি বুলনু (বললাম) ব্যাটা (ছেলে) দ্যাশের (দেশের) পরিস্থিতি খারাপ, তুমি বাড়িতে অ্যাসো (এসো)। তখন ব্যাটা (ছেলে) আমাকে বুঝাছে (বোঝাচ্ছে)- মা বাড়িতে য্যায়া বসি থাকলি কি (থাকলে কি) দ্যাশ (দেশ) স্বাধীন হবি (হবে)। আমি যাব কয়েকদিন পরে মা। তুমি ধৈর্য ধর, কান্না করো না। অ্যাসবো (আসব) বলে আর আসেনি।’

ছেলের স্মৃতি মনে পড়ে সবসময় উল্লেখ করে রায়হানের বাবা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে প্রতিদিনই কথা হতো। কথা না বললে ভালাই লাগতো না। এখন আর কথা হয় না। মনে পড়লেই কান্না আসে। মন খারাপ হয়ে যায়। আসলে কত সুন্দর করে ডাকত। প্রতিদিন এশার নামাজের পড়েই ফোন করে বলত- আব্বা কি খেয়েছেন? কেমন আছেন? কোথায় আছে? এখন একথা বলার মানুষ নাই। বাড়িতে তার ব্যবহারের জিনিসপত্র দেখেলে খারাপ লাগে। সব জিনিসপত্র আছে, কিন্তু ছেলেটা নাই। 

তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার দিনে দুপুর ১টার দিকে গুলি লাগে। কিন্তু আমি শুনতে পাই, বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে। রাজশাহী কলেজের এক ছাত্র ফোন দিয়ে বলে- চাচা ভাইয়ের পায়ে গুলি লেগেছে। কি ঘটনা বিস্তারিত জানার জন্য অন্য মানুষকে কল দিলে তারা জানায়, রায়হানের মাথায় গুলি লেগেছে। তখন মনে মনে বলি, ছেলেকে আমি আর পাব না। মেডিকেল গিয়ে দেখি অপারেশন থিয়েটারে নিয়েছে। সেদিন দূর থেকে ছেলের মুখ দেখেছি। সেদিন গেল, তারপর দিনও গেল। সাত তারিখে দুপুর ১২টার দিকে ডাক্তার বলে ছেলে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ দিলে কাল (৮ আগস্ট) বেডে দেব। এ কথা শুনে তখন মনটা ভালো হয়ে গেছিল। ওই দিন বিকেল ৩টার দিকে শুনি ছেলের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে।’

আমি কষ্ট পাব বলে হাসপাতালে রায়হানের বন্ধুরা আমাকে মিথ্যা বলত। ফোন দিলেই তারা বলতো চাচা রায়হান ভাই ভালো আছে, দোয়া করেন। এই বলে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় যোগাযোগ করা হয়েছিল। চিকিৎসার জন্য তাকে হেলিকাপ্টারে নেওয়ার প্রস্তুতি হয়েছিল। কিন্তু রাতে আরও শারীরিক অবস্থা খারপ হয়ে গেল। ডাক্তার বলে এখানেই থাক। সন্ধ্যার দিকে ছেলেটা মারা গেল। 

আলী রায়হানের ছোট ভাই রানা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তার মেস থেকে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজগপত্র নিয়ে আসা হয়েছে। সবগুলো স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি। তার বই, খাতাসহ বিভিন্ন স্মারক রেখে দেওয়া হয়েছে। তার শখের বিড়ালটা মেস থেকে নিয়ে আসার পরে হারিয়ে গেছে। ভাইয়ার বিড়ালটা খুব প্রিয় ছিল। নিজে যে মাছ খেতে সেই মাছের অর্ধেক বিড়ালের জন্য রেখে দিত। বাড়িতে বিড়ালটি নিয়ে আসার পরে একমাস বেঁধে রাখা হয়েছিল। এরপর ছেড়ে দিলে তিন-চার মাস বাড়িতে ছিল। এরপর একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে চলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ভাইয়ার শুধু বিড়ালটা হারিয়ে ফেলেছি, তা ছাড়া সবকিছুই আছে।’

তিনি বলেন, ‘ভাইয়া পড়াশোনা শেষ করেছে হিসাববিজ্ঞান নিয়ে। তার চাকরি হওয়ার বেশি সম্ভাবনা ছিল ব্যাংকে। কিন্তু সুদের কারণে ব্যাংকে ইন্টারভিউ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করত না। ইবনে সিনাতে দুই বার পরীক্ষা দিয়ে একবার ফাস্ট হয়েছিল। তখন সংগঠনে থাকার কারণে চাকরিটা করেনি। কারণ সময় দিতে হবে সংগঠনের সঙ্গে বলে। চাকরি হলে সময় দিতে পারবে না ভেবে যায়নি। এছাড়া একবার আরএফএলে চাকরি হয়েছিল। সে চাকরিও করেনি। ভাইয়া মাঝখানে ভেবেছিল ডিগ্রি নিয়ে বিদেশে যাবে। কিন্তু তা আর হলো না।’

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে নগরের আলুপট্টিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা আলী রায়হান। উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ আগস্ট তিনি মারা যান। তিনি রাজশাহী মহানগর ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

আলী রায়হান নিহতের ঘটনায় একই বছরের ২০ আগস্ট নগরীর বোয়ালিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন ছোট ভাই রানা ইসলাম (২১)। এই মামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সদ্য সাবেক সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনসহ ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে এজাহারে ৫০ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে।

মামলায় এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, তার ভাই জেডু সরকার, নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ, যুবলীগ কর্মী জহিরুল হক, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রকি কুমার ঘোষ ও শফিকুজ্জামান শফিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সিরাজুম মুবীন প্রমুখ।

শাহিনুল আশিক/আরকে