ঘড়ির কাটা তখন সোয়া ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার ঘরে। শহরের কাস্টমস মোড় এলাকায় মার্কেটে যে যার মতো কেনাকাটা, আড্ডা অথবা ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। কিন্তু মিনিট তিনেকের মধ্যে পাল্টে গেল পুরো দৃশ্যপট। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই একে একে তিনজনকে গুলি করেন এএসআই সৌমেন রায়। নিভে যায় তিনটি তাজা প্রাণ। তিনটি জীবন নিতে খরচ করা হয় ১১টি গুলি। পুরো ঘটনাটি তিন মিনিটের মধ্যে ঘটেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোববার বেলা সোয়া ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে কাস্টমস মোড়ের নাজ ম্যানশন ভবনের সামনে দুইজন পুরুষ, একজন নারী ও এক শিশু দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। তার আগে তারা হোটেলে কিছু খেতে যান। কিন্তু কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তাদের বসতে দেয়নি হোটেল মালিক।

পরে তারা নাজ ম্যানশনের নিচতলার কলাপসিপল গেটের ভেতরে চলে যান। সেখানে হঠাৎ চারটি গুলির শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। একজন নারী এবং একজন পুরুষ গুলি লেগে মাটিতে পড়ে যায়। 

এর মধ্যে দেখা যায়, ওই শিশুটি দৌড়ে বের হয়ে আসে। সে ভয়ে পালাতে যাচ্ছিল। এ সময় বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে পেছনে পিস্তল হাতে ছুটে আসেন একজন অস্ত্রধারী। তিনি শিশুটির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পর পর তিনটি গুলি করেন। এরপর আবার দ্রুত কলাপসিপল গেটের মধ্যে চলে যান। 

তারা আরও জানান, এ সময় উপস্থিত লোকজন তাকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় তিনি গেটের মধ্যে গিয়ে মোবাইলে কথা বলেন এবং উপস্থিত মানুষকে লক্ষ্য করে চারটি গুলি করেন। অস্ত্রধারীর মাথায় লাগে স্থানীয়দের ছোঁড়া ইট। তবে তার ছোঁড়া গুলি স্থানীয় কারও গায়ে লাগেনি। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত হয়। 

প্রত্যক্ষদর্শী বিশু মিয়া বলেন, আমি ঘটনাস্থলের পাশেই মসজিদের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। গুলির শব্দ শুনে আমরা দৌড়ে সামনে গিয়ে দেখি একটা বাচ্চা দৌড়াচ্ছে। এ সময় একজন এসে বাচ্চাকে তিনটা গুলি করল। প্রায় ১১টি গুলির শব্দ পাওয়া যায়। তিন মিনিটে তিনজনকে হত্যা করা হয়।

পরকীয়ার জেরে কুষ্টিয়া শহরে প্রকাশ্যে স্ত্রী সৎ সন্তান ও এক যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এএসআই সৌমেন রায়কে একমাত্র আসামি করে নিহত শাকিল খানের বাবা মেজবার রহমান রোববার (১৩ জুন) রাতে এ হত্যা মামলা দায়ের করেন। 

এ ঘটনায় খুলনা রেঞ্জ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুলনা রেঞ্জের দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ কুষ্টিয়ায় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে ঘটনা তদন্তে খুলনা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খায়রুল আলম। তিনি বলেন, ঘটনা জানার পর সৌমেন রায়কে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরপর তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে সর্বশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কুষ্টিয়া পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সৌমেন রায় ২০১৫ সালে কনস্টেবল থেকে এএসআই পদে উন্নীত হন। পরে ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানায় যোগ দেন। সেখান থেকে জেলার অন্যান্য থানায়ও কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ মিরপুর থানার হালসা ক্যাম্পে ছিলেন। এরপর বাগেরহাট হয়ে খুলনার ফুলতলা থানায় যোগ দেন।

এর আগে রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড় এলাকার নাজ ম্যানশন মার্কেটের বিকাশের দোকানের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশ সৌমেনকে ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র, গুলি ও ম্যাগজিনসহ আটক করেছে।

জানা গেছে, এএসআই সৌমেনের কর্মস্থলে বদলি হওয়ার পর থেকেই বিকাশকর্মী শাকিলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান আসমা। তবে এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি সৌমেন। আসমার প্রতি মনে ক্ষোভ জমিয়ে রাখেন। সেই ক্ষোভ থেকেই দিন দুপুরে প্রকাশ্যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেন সৌমেন। 

স্থানীয়রা জানায়, আসমার দ্বিতীয় স্বামীর সন্তান ছিল রবিন। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর সৌমেনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান তিনি। এরপর তারা বিয়ে করেন। কিন্তু বদলি হওয়ার পর সৌমেনকে ছেড়ে বিকাশকর্মী শাকিলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান আসমা। পরকীয়া প্রেমের সম্পর্কের জেরে তিনটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল।

নিহতরা হলেন- এএসআই সৌমেনের স্ত্রী আসমা (২৫), সৎ ছেলে রবিন (৫) এবং পরকীয়া প্রেমিক শাকিল (২৮)। শাকিলের সঙ্গে আসমার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে শাকিলের সঙ্গে আসমার পরকীয়া সম্পর্ক ছিল।

রাজু আহমেদ/এসপি