কুড়িগ্রামের তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে গড়ে ওঠা চরগুলোতে নদী ভাঙনে প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে ভিটেমাটি। একদিকে চর ভাঙে, অন্যদিকে নতুন চর জেগে ওঠে। প্রতিবছর জেলায় দুই হাজারের বেশি পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের শওকত আলী (৬২) ও ছলিমা বেগম (৫০) দম্পতি ৩০ বছরে ১০ বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি তারা আবারও বসতভিটা হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কোনো রকমে আশ্রয় নিয়েছেন পার্বতীপুর চরে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জেলার চারটি নদীর ভাঙনে ১৫ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী ও রাজিবপুরে ৪৪৭ পরিবারের ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। রৌমারী, রাজারহাট ও ফুলবাড়ীর বিভিন্ন গ্রামও ভাঙনের শিকার হয়েছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ভগবতীপুরে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় দুটিই হুমকির মুখে রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে বিলীন হতে পারে। পাঁচগাছি ইউনিয়নের পূর্ব গোবিন্দপুরে গত ২০ দিনে ৩০টি বাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। এছাড়াও মসজিদ, বিদ্যালয় ও একটি সেতুও ঝুঁকিতে রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আদম আলী (৬৪) বলেন, কতবার যে নদীর ভাঙনে ঘর হারাইলাম, হিসাব নাই। এবারে পুরোনো ভিটে ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

পাঁচগাছি ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল বাতেন সরকার বলেন, সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করা হবে।

চিলমারী উপজেলার চিলমারী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়নে কয়েক বছরে শত শত বাড়িঘর ও হাজার হাজার ফসলি জমি বিলীন হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলে কোনো লাভ হয়নি। ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা না নিলে চিলমারীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে এই ইউনিয়নটি।

রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর অপর পাড়ে চর গতিয়াসামে এলাকার খলিল মিয়া (৬৭) বলেন, জন্মের পর থেকেই বাপ-দাদারা বাড়িঘর করে ছিলাম। নদী ভাঙলে আরেক দিকে চলে যাই। এবার সব সম্পত্তি নদী খেয়ে গেছে। ফলে ভিটার মায়া ত্যাগ করে এবার জেলা ছেড়ে অন্য জেলা পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাটের গোকুন্ডা ইউনিয়নেচলে যেতে হচ্ছে।

উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের মজিবর রহমান (৫০), আইয়ুব আলী (৬০), তৈয়ব আলী (৫৬), মর্জিনা বেগম (৪৫) ও সাজিনা বেগম (৬০) বলেন, নদীর ভাঙনে সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। শত শত একর আবাদি জমি বাড়িঘর-ভিটে সব নদীতে চলে গেছে। তিস্তা নদী আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। আমাদের চলার মতো কিছুই থাকল না।

চর গোড়াইপিয়ার এলাকার দবির উদ্দিন (৬৭)বলেন, তিস্তার ভাঙনে মসজিদসহ আমার বাড়ি আবারও নদীগর্ভে চলে যায়। কয়েক দিন হয়ে গেল ঠিকভাবে পেট ভরে খেতে পারছি না।

ফুলবাড়ী উপজেলার চরগোরক মন্ডল এলাকায় করিম মিয়া বলেন, ‘কি কই বাহে, ৬০ বছর বয়সে কমপক্ষে চার-পাঁচ বার বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হইছে। বাড়িঘর জমিজমা হারিয়ে এখন নিঃস্ব। আমার নিজস্ব জমি না থাকায় গত চার বছর ধরে মানুষের জমিতে ঘরবাড়ি করে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ধরলার তীব্র ভাঙন একেবারে বাড়ির কাছেই চলে এসেছে। এখন আমার শ্যালকের জমিতে বসবাস করার জন্য ঘরবাড়ি সরানোর কাজ শুরু করেছি, কিন্তু টাকার অভাবে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারে একটি ছোট সুতা ও রশির দোকান করে কোনো রকমে জীবন-যাপন করছি।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, ভাঙনকবলিত স্থানগুলোতে ভাঙন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মমিনুল ইসলাম বাবু/আরএআর