হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের প্রথম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করা এবং ও স্বল্প সময়ে যাতায়াত করতে নেওয়া হয়েছে এই প্রকল্প। কয়েক দফা সময় বাড়ানোর সঙ্গে বেড়েছে প্রকল্পটির ব্যয়। তবে বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা না করে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের ওপর উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। বর্ষা এলে সেই দুর্ভোগ বেড়ে বর্ণনাতীত ভোগান্তিতে রূপ নেয়।

গাজীপুরের জৈনাবাজার থেকে ঢাকার গুলিস্তানে প্রতিদিন তিনবার যাওয়া-আসা করতেন প্রভাতী পরিবহনের চালক বিল্লাল হোসেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিআরটি প্রকল্প উন্নয়ন কাজের জন্য যানজটের কবলে পড়ে একবারের বেশি তিনি যাওয়া-আসা করতে পারেন না। বিল্লাল হোসেন বলেন, জয়দেবপুর-টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত ১২কিলোমিটার সড়কে যেতে কিছুদিন আগেও লাগত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। আর এখন সামান্য বৃষ্টি হলেই লাগছে ৫-৬ ঘণ্টা। ২০ মিনিটের সড়কে এখন আর একবারের বেশি যাতায়াত করা যায় না।

ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন বেপারি বলেন, সোমবার রাত ১১টায় ব্যক্তিগত গাড়িতে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা থেকে উত্তরার উদ্দেশে রওনা দিই। ভোর সাড়ে ৪টায় বাসায় পৌঁছাই। 

গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার সাবেক কর আদায়কারী মোবারক হোসেন বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় গাজীপুর থেকে উত্তরায় যাওয়ার জন্য বাসে উঠি। এক কিলোমিটার এলাকায় ভোগড়া পর্যন্ত আসার পর যানজটের কবলে পড়ি। বাসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর হেঁটেই রওনা হই। রাত আড়াইটায় বাসায় পৌঁছাই।

শ্রীপুর উপজেলা হাসপাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক জানান, শ্রীপুরের হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগের রোগী আগে ঢাকায় পাঠানো হতো। এখন মহাসড়কের জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে পড়ে থাকতে হয় রোগীদের। তাই জরুরি বিভাগের রোগীদের এখন রাজধানী ঢাকায় পাঠানোর পরিবর্তে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে ২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। কয়েক দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে ২০১৮ সালে আনা দ্বিতীয় সংশোধনীতে প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা এবং সময় বাড়ানো হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। তবে সময়ের মধ্যে প্রকল্পের অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরুর পরই অপরিকল্পিত কাজ, বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, যানজট কমানোর কোনো পদক্ষেপ বা বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি না করেই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় রাজধানীর উত্তরের জেলাগুলোর মানুষ কয়েক বছর ধরেই ভোগান্তি পোহাচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি বেড়েছে কয়েক গুণ। 

সড়কের বিভিন্ন অংশে যানবাহন আটকে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বৃষ্টির পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জলজটেরও সৃষ্টি হচ্ছে। চলতি মাসের প্রথম থেকেই ১২ কিলোমিটার এই সড়ক যেন মানুষের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টঙ্গী থেকে চেরাগ আলী, সাতাইশ, বোর্ডবাজার, গাজীপুর স্টেশন রোড, চৌধুরী বাড়ী, তারগাছ, ঢাকা বাইপাস মোড় ও ভোগড়া এলাকায় সড়কে খানাখন্দ বেশি। বিশেষ করে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে ড্রেন নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

ধীরগতির উন্নয়ন কাজ, সিংহভাগ সড়ক দখল করে নির্মাণযজ্ঞ, সড়েকর মধ্যেই নির্মাণ সামগ্রী রাখা, ধীরগতির কাজ, কয়েকস্থানে এক লেনের সড়কে অধিক যানবাহনের চাপেও যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অসহনীয় এ যানজটে গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় সময়মতো পণ্য পরিবহনেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। 

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক উত্তর) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মূলত গাজীপুর থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক খানাখন্দে ভরা। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেইসঙ্গে উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। অধিকাংশ স্থানে সড়ক বিভাজন নেই। সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে যানবাহন আটকে পড়ছে। আমরা সীমিত জনবল দিয়ে কোনোভাবেই সড়কের এই অংশে যানজট নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। 

তিনি আরও বলেন, এই সড়কে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা নেই। কাজ চলমান থাকায় একদিকে সড়ক সরু হয়ে পড়েছে অন্যদিকে যানবাহনের চাপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে বিআরটি প্রকল্প পরিচালক এএসএম ইলিয়াস শাহ বলেন, প্রকল্প শুরুর আগে বিকল্প সড়ক নির্মাণের সুযোগ না থাকায় ডাইভারশন সড়ক নির্মাণ করা যায়নি। তবে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও করোনা মহামারির মধ্যেও আমরা ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৬০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি। কোনো অঘটন না ঘটলে নির্ধারিত সময়ে আগামী এক বছরের মধ্যেই কাজ শেষের আশা রয়েছে। 

জলাবদ্ধতা ও যানজটের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, টঙ্গীসহ দু’একটি স্থানে নির্মাণ কাজের জন্য সামান্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। আমরা এসব স্থানে দ্রুত কাজ করছি। চলতি মাসেই এ কাজ সম্পন্ন হলে আশা করছি আর যানজট হবে না।

শিহাব খান/এসপি/জেএস