বন্যার ক্ষত পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন ঝর্ণা, রহিমা-পান্নারা
গত বছরের ভয়াবহ বন্যা যেন এক দুঃস্বপ্ন হয়ে নেমেছিল নোয়াখালীর মানুষের জীবনে। ভারতের উজানের পানি ও টানা বর্ষণে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ঘরবাড়ি ভেসে যায়, জমির ধান-সবজি নষ্ট হয়, থেমে যায় জীবিকা। অনেক পরিবার আশ্রয় নেয় আশ্রয়কেন্দ্রে।
সেই ভয়াবহ সময় পার করে এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো। পানি নেমে যাওয়ার পর বাড়িঘর মেরামত, ফসল পুনরায় রোপণ এবং জীবিকা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। অনেক কৃষক জমিতে নতুন করে ধান ও সবজি লাগাচ্ছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকানপাট মেরামত করে আবারও ব্যবসা শুরু করেছেন।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে, সদর উপজেলার এওজবালিয়া, কালাদরাপ ও আন্ডারচর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী আলী হোসেন, পান্না বেগম, ঝর্ণা আক্তারসহ অনেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি চেষ্টা করছেন সঞ্চয় করতে।
তবে এখনো ভোগান্তি পুরোপুরি কাটেনি। অনেকেই স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে কাজ করছে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ান হিউম্যানিটেরিয়ান পার্টনারশিপের (এএইচপি) অর্থায়নে এবং অক্সফামের সহযোগিতায় কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার- কোডেক এর বাস্তবায়নে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার ৬১৭টি পরিবারকে বহুমুখী মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৭৫০ পরিবারকে নগদ সহায়তা, কম্বল, খাদ্য ও স্বাস্থ্যবিধি সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ক্যাশ-ফর-ওয়ার্ক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তারা ৪৩টি সড়ক মেরামত করেছে এবং প্রত্যেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা মজুরি পেয়েছে। জীবিকা পুনরুদ্ধারে আরও ৭৫০ পরিবারকে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরুর জন্য ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৫২টি টিউবওয়েল, ১০০টি ল্যাট্রিন মেরামত, ১৫টি নতুন টিউবওয়েল, ৫০টি নতুন ল্যাট্রিন ও নারীদের জন্য ৫০টি গোসলখানা নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ ও ১৮০টি যুব গ্রুপ গঠন করে সচেতনতা কার্যক্রমও পরিচালিত হয়েছে।
প্রতিবন্ধী আলী হোসেন হারিয়েছিলেন তার ছোট্ট দোকানঘর। আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক সপ্তাহ কাটাতে হয়েছে সন্তানদের নিয়ে। এখন তিনি আবার ছোট দোকানটি মেরামত করেছেন। সহায়তা পাওয়া কিছু টাকা দিয়ে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছেন। আলী হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যা সবকিছু নিয়ে গিয়েছিল। আমার দোকানের মালামাল নষ্ট হয়েছে। আমি কোনো কাজ করতে পারি না। বসে বসে দোকান করতে পারি। কোডেকের মাধ্যমে এখন আবার দোকান চালু করতে পেরেছি। পরিবারের পেছনে খরচ শেষে প্রতিদিন টাকা জমাচ্ছি। আল্লাহ চাইলে ভালো দিন ফিরবে।
বসতঘরে হাটু পানি হওয়ায় ঝর্ণা আক্তার বন্যায় স্বামী সন্তান নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন অন্যের বাসায়। সেলাই মেশিন পেয়ে তিনিও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ঝর্ণা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে অন্যের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এক বেলা খেয়ে থেকেছি। আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম প্রায় ২০ দিন। সব শেষে বাড়ি ফিরে দেখি সব শেষ। একটা সেলাই মেশিন আমার ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। আমি আগেও সেলাইয়ের কাজ করতাম কিন্তু বন্যায় কাপড় আর মেশিন সব নষ্ট হয়ে গেছে। আমি পরিবারের পেছনে খরচের পাশাপাশি সঞ্চয় করছি।
কালাদরপের গৃহবধূ রহিমা বেগমের জমির সব ফসল ডুবে গিয়েছিল। এরপর তিনি আবার শীতকালীন সবজি লাগিয়েছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি সবজি বিক্রি করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিজেরা খেয়েছি, মানুষদের দিয়েছি। সবজি ও কৃষিকাজ আমার ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। আমার পরিবারে আমি এখন স্বাবলম্বী। আলহামদুলিল্লাহ বন্যার ক্ষত কাটিয়ে এখন ঝর্ণা, রহিমা ও পান্নাদের মতো অসংখ্য পরিবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তাদের চোখে এখনো বেদনার ছাপ থাকলেও ভেতরে ভেতরে জেগে উঠছে এক দৃঢ় প্রত্যয়— “সব হারিয়েও আবারও উঠে দাঁড়ানো যায়।”
প্রকল্পের মনিটরিং অফিসার শর্মী আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যাচাই-বাছাই করে উপকারভোগী নির্বাচন করেছি। তারা আজ স্বাবলম্বী এবং নিজেরাই আবার সঞ্চয় করছেন। প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবাসহ বিভিন্ন অসহায় পরিবার আমাদের মাধ্যমে ক্ষত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ফলে তাদের দীর্ঘমেয়াদে জীবিকা উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ায় এটি পরিবারগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত হলে দারিদ্র্য নিরসণ ও টেকসই উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোমায়রা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নোয়াখালীর মানুষ বহুদিন ধরে বড় ধরনের বন্যার ভয়াবহতা দেখেনি। তাই এবারের বন্যায় এমন ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা তাদের কল্পনাতেও ছিল না। বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় বহু পরিবার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারি সহায়তা ও বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে ধীরে ধীরে অনেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। আমি আশাকরবো কোডেক আগামীতে আরও কাজ করবে এবং আরও যারা ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে তারা উপকৃত হবে।
হাসিব আল আমিন/আরকে