ঠাকুরগাঁওয়ের লামিয়া এখন ডাকসুর শামসুন্নাহার হলের ক্রীড়া সম্পাদক
প্রত্যন্ত গ্রামে কুঁড়েঘরে বেড়ে ওঠা লামিয়া আক্তার লিমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামসুন্নাহার হল সংসদের বহিরঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তার এই সাফল্যে আনন্দে আত্মহারা মা-বাবাসহ পাড়া-প্রতিবেশীরা। পাড়া-মহল্লা থেকে চায়ের টং সর্বত্রই এখন হকি ও খো-খো খেলোয়াড় লামিয়াকে নিয়েই আলোচনা। অভিনন্দন আর শুভেচ্ছার সাগরে ভাসছেন তার মা-বাবা। তবে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে লামিয়াকে। দরিদ্র ঘরে বেড়ে ওঠা এই তরুণীর সংগ্রামের গল্পটা বেশ লম্বা।
লামিয়া ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের মধ্যজামুরী পাড়া গ্রামের দিনমজুর দুলাল ইসলাম ও গৃহিণী সুমি বেগম দম্পতির মেয়ে। চার ভাই-বোনের মধ্যে লামিয়া সবার বড়। মেজো বোন লিজা আক্তার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি), আরেক বোন খুশি আক্তার এবার সালান্দর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ও ছোট ভাই সেকেন্দার বাদশা স্থানীয় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।
লামিয়া ২০১৯ সালে সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০২১ সালে এইচএসসি পাস করে ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। এরপর সেই কলেজে এক বছর পড়াশোনা করার পর খো খো খেলা কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সুযোগ হয় তার। দারিদ্র্য ও সামাজিক বাধা পেরিয়ে বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। এবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বহিরঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
লামিয়ার হকি খেলার হাতেখড়ি কোচ আবু ইয়াসিন মো. মাসুদ রানা। সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক ও প্রশিক্ষক তিনি। বলা যায় কোচ আবু ইয়াসিন মো. মাসুদ রানার হাত ধরেই ক্রীড়াঙ্গনে উঠে আসা লামিয়ার। ছোটবেলা থেকেই খেলার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। জেলাভিত্তিক খেলা দিয়ে তার যাত্রা শুরু। এরপর বিভাগীয় পর্যায়েও খেলেছেন বেশ কয়েকবার। চার ভাই-বোনের সবার বড় লামিয়া। তাই দায়িত্বও একটু বেশি। কিন্তু খেলা যার স্বপ্ন, খেলা যার ধ্যানজ্ঞান, তিনি কি আর ঘরের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন। দিনমজুর বাবাও মেয়ের স্বপ্ন পূরণে পরিশ্রম করে চলেছেন রাত-দিন সমান তালে। লামিয়া শুধু হকি খেলায় নয়, তার সঙ্গে খো-খো খেলোয়াড় হিসেবেও বেশ নাম কামিয়েছেন জাতীয় পর্যায়েও। খো খো তে ২০২৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে নিজেকে গড়ে তুললেও পাসপোর্ট জটিলতার কারণে বিদেশের মাটিতে পা রাখা সম্ভব হয়নি তার।
লামিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি পাকা ঘর, তাও আবার পলেস্তারা খসে পড়ে গেছে। বাড়িতে এলে এককক্ষে তিন বোনকে খুব কষ্টে রাত্রীযাপন করতে হয়। আর পাশে আরেকটি ঘর রয়েছে সেখানে তার মা-বাবা ও ছোট ভাই ঘুমায়। দেখা যায় ঘরের টিনের চালে মরিচা ধরে কিছু জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। বেড়ার টিন, কাঠের ভাঙাচোরা দরজা ও জানালা নেই বললেই চলে। যেটা আছে, সেটা খুবই জরাজীর্ণ। ভেঙে পড়তে পারে যেকোনো সময়। বৃষ্টির পানি ঠেকাতে টিনের চালের নিচে পলিথিন টাঙানো হয়েছে। এসব ঘরে বসবাসে কষ্টের শেষ নেই লামিয়ার পরিবারের। তবে পাশেই আরেকটি নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন লামিয়ার বাবা দুলাল ইসলাম। মেয়ে এলেই নতুন ঘরে ওঠবে বলে এখনো ভাঙাচোরা ঘরে কোনোমতো থাকছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
তবে লামিয়ার এই অর্জনে খুশি পাড়া প্রতিবেশীরাও। তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, লামিয়া জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। আমাদের ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের পাড়ার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। এটা সত্যিই আমাদের জন্য গর্বের। তাদের জমি-জায়গা বলতে তেমন নেই। অন্যের জমি চাষাবাদ করে খায়, আর তার বাবা মাঝে মধ্যে কুলির কাজ করে। এ দিয়েই তাদের ৬ সদস্যের সংসার চলে। তবে মেয়ে খুবই মেধাবী। সেও অনেক কষ্ট করেছে। বলা যায় তার আগ্রহ প্রচেষ্টা ও জেদেই আজ সে এই পথে গেছে। লামিয়ার জন্য শুধু তার মা-বাবা নয়, আমরাও গর্বিত। তাকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে।
হকি খেলোয়াড় মনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিঃসন্দেহে এটা খুশির খবর। লামিয়া ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছে। সে পড়াশোনা ও খেলাধুলায় অনেক মেধাবী। আমরা দুইজনেই এক সঙ্গে খেলতে যেতাম।
লামিয়ার মা-বাবা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা খুশি। খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছি। মেয়ে আজ আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। সবাই এখন ফোন করে অভিনন্দন জানায়। আমাদের কষ্ট সার্থক হয়েছে।
লামিয়া আক্তার লিমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের বহিরঙ্গন পদে ক্রীড়া সম্পাদকের প্রতিনিধিত্ব করছি। গঠনমূলক কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি। শামসুন্নাহার হলের ক্রীড়াঙ্গনে স্বচ্ছতার সাথে কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকব সেই সাথে জেলা ও দেশের নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বদাই সচেষ্ট থাকব। এ ক্ষেত্রে আমি চাই আমার হলে দুর্নীতি, দখলদারিত্ব এসবের বিরুদ্ধে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতামূলক ক্রীড়াঙ্গন গড়ে তুলতে চাই।
তিনি আরও বলেন, আমার হাতেখড়ি মূলত সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক আবু ইয়াসিন মো. মাসুদ রানা স্যার। স্যারের হাত ধরেই আমার খেলার জগতে আসা। সালন্দর বিদ্যাপীঠের মাঠে রানা স্যারের হাত ধরেই ক্রীড়াঙ্গনে আমার উঠে আসা। স্যারের স্নেহসুলভ দোয়া ও ভালোবাসায় আজকে আমি এতোদূর আসতে পেরেছি।
এ বিষয়ে সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক ও কোচ আবু ইয়াসিন মো. মাসুদ রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, লামিয়াদের আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে মাঠে নিয়ে আছি। মাঠে নিয়ে আসার পরে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়। সব কিছুই আমি ফেইস করেছি। সব চেয়ে বড় জিনিস হতো তাদের আগ্রহ ও উৎসাহ। তাদের আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে আমি অভিভূত হই। এবং তারা যে পরিশ্রমী তাদের ফসল আজ আপনারা দেখতে পারছেন। আমার বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলে আসছে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন খেলার কোটায় মেয়েরা সুযোগ পায়। তাদের মধ্যে রশিদা, সাথী ও লামিয়া রয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো প্রতিটি পরিবারের মা-বাবাদের আগ্রহ ছিল যেন তাদের সন্তানরা ভালো জায়গায় যেন যায়। তারা খুবই গরিব ছিল। তাদের আয় রোজগারের পথ সীমিত। তারপরেও তারা সেই সব পথ অতিক্রম করে ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। লামিয়া এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামসুন্নাহার হলের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের। আমরা গর্ববোধ করি লামিয়ার জন্য।
সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মকবুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, লামিয়া ১৯ সালে আমাদের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। সে মেধী ও গরিব ঘরের মেয়ে। আমাদের স্কুলের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক রানা স্যার তাকে প্রতিনিয়তই খেলাধুলায় প্রশিক্ষণ দিতো। এবং সে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে। আমরা খুবই খুশি। স্কুলের পক্ষে থেকে তাকে স্বাগতম জানাই।
এমএএস