অসময়ে তরমুজ চাষে বাজিমাত ওসমান ও সুমনের
তরমুজের মৌসুম এখন নয়, তবুও মাচায় ঝুলছে হাজার হাজার রসালো তরমুজ। গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছিলেন ওসমান গনি। এবার বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে পেয়েছেন বাম্পার ফলন। পাশাপাশি ভালো দামও পেয়ে লাভবান হচ্ছেন কৃষক ওসমান গনি ও সুমন মিয়া।
নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার গরাডোবা ইউনিয়নের পাথারিয়া গ্রামের কৃষক আলী ওসমান ও সুমন মিয়া তাক লাগিয়েছেন অসময়ে তরমুজ চাষ করে। অন্যান্য বছর এই সময়টায় তারা রবিশস্য আবাদ করতেন। বর্তমানে প্রায় ২ একর জমিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজের চাষ করেছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
আধুনিক মালচিং ও মাচা পদ্ধতিতে ‘সুগার কুইন’ হলুদ ও সবুজ জাতের তরমুজ আবাদ করে ভালো ফলন পেয়েছেন তারা। মালচিং ব্যবহারে আগাছা ও রোগবালাই সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আর মাচা ব্যবহারে কম জায়গায় বেশি ফলন সম্ভব বলে জানান কৃষকরা। তাদের মতে, এ সময় অন্যান্য ফসলের তুলনায় তরমুজের চাহিদা ও দাম বেশি থাকায় লাভ হয় প্রায় তিনগুণ।
সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই একর জমিতে কৃষিকাজ করছেন আলী ওসমান। এর মধ্যে ১২০ শতাংশ জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
আলী ওসমান বলেন, আমরা আগের পদ্ধতিতে চাষ করে তেমন লাভ পেতাম না। এবার আমার কলেজপড়ুয়া ছেলে সারোয়ার আহমেদ সায়েম বলল, বাবা, আমার পরামর্শ অনুযায়ী তরমুজ চাষ করো, লাভবান হবে। তার কথায় রাজি হই। সে নিজেই সার ও বীজ সংগ্রহ করেছে। আমি জমি তৈরি করে বীজ রোপণ করি। আমরা এবার আগের মতো করে চাষ করিনি।
তিনি আরও বলেন, এবার মালচিং পদ্ধতিতে চারা রোপণ করেছি। বাম্পার ফলন হয়েছে। তরমুজ চাষে সময়ও কম লাগে। রোপণ থেকে ৬০-৭০ দিনের মধ্যেই ফসল তোলা যায়। প্রতি ১০ শতাংশে ১২০০টি পর্যন্ত তরমুজ হয়েছে। প্রতি কেজি তরমুজ ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি করছি। আমার ৪০ শতাংশ জমির তরমুজ ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আরও ৮০ শতাংশ জমির তরমুজ কাটার সময় এসেছে। এখন এলাকার লোকজন ভিড় করছেন। এলাকাবাসী বলছেন, এরকম তরমুজ তো জীবনে দেখিনি, তাও আবার বর্ষাকালে!
আরেক তরমুজ চাষি সুমন মিয়া বলেন, আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে প্রতিবেশী আলী ওসমানকে দেখে। তিনি গত বছর তরমুজ চাষ করে লাভবান হন। এবার আমি ৪০ শতাংশ জমিতে তরমুজ চাষ করি। আল্লাহর রহমতে ফলন ভালো হয়েছে। প্রতিটি তরমুজ ২-৫ কেজি পর্যন্ত হয়েছে। আগে নানা সবজি চাষ করলেও তেমন লাভ পেতাম না। এবার আশা করছি প্রায় চার লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারব। বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেকেই দেখতে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মকর্তারা আমাদের সহযোগিতা করেছেন, নিয়মিত পরিদর্শন করেছেন। আরেকটি সুবিধা হলো- অন্যান্য ফসলের মতো বাজারে গিয়ে বিক্রি করতে হয় না। তরমুজের ক্ষেত্রে পাইকার নিজেরাই মাঠে এসে কিনে নিচ্ছেন। এতে করে ঝামেলা কম।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তরমুজ মৌসুমি ফসল না হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা বেশি। ফলে কৃষকদের বাজারে গিয়ে তরমুজ বিক্রি করতে হয় না। ব্যবসায়ীরা মাঠ থেকেই সংগ্রহ করেন। এতে তরমুজ বাজারজাত করতে ভোগান্তি নেই। ফলে অসময়ে তরমুজ চাষে আগ্রহ বাড়ছে। আশপাশের অনেক আগ্রহী কৃষক প্রতিদিনই তাদের বাগানে এসে পরামর্শ নিচ্ছেন।
স্থানীয় একটি হাই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বাবুল বলেন, আমি প্রায়ই এখানে এসে দেখি বন্ধু কীভাবে চাষ করছেন। তিনি আগে নানা শাকসবজি চাষ করলেও এবার তরমুজ চাষ করে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন, যা আমার কাছে নতুন ও মুগ্ধকর। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ আসছেন তার সফলতা দেখতে।
পাশের গ্রাম থেকে আসা কৃষক মো. রাজিব বলেন, আমি তরমুজ চাষের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে এখানে এসেছি। কীভাবে চাষ করছেন তা জেনেছি। এখানে এসে জাতের নাম জেনেছি। তারা মালচিং পদ্ধতির সঙ্গে মাচাও ব্যবহার করছেন, যার ফলে তরমুজ নষ্ট হচ্ছে না।
নেত্রকোণা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, নেত্রকোণায় রবি মৌসুমে তরমুজ চাষ হয় ৩২ হেক্টরে। তবে গ্রীষ্মকালীন তরমুজের আবাদ এখনও কম। তারপরও আমাদের চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা কৃষকদের মালচিং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। এ পদ্ধতিতে ভালো ফলন পাওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। আমাদের প্রদর্শনী দেখে এখন অনেক উদ্যোক্তা কৃষক মালচিং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করছেন। কেন্দুয়া, আটপাড়া এবং কলমাকান্দা উপজেলায় কিছু আবাদ হয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে অবস্থাও ভালো। কৃষকরা খোলা জায়গায় এসব বিক্রি করছেন এবং দামও ভালো পাচ্ছেন। আমরা আশা করি, তাদের দেখে নেত্রকোণায় গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ আরও বিস্তৃত হবে।
চয়ন দেবনাথ মুন্না/এআরবি