শাসন, হাসি আর অশ্রু—মির্জা ফখরুলের স্মৃতিতে রুস্তম স্যার
শিক্ষক শব্দটির ভেতরে রয়েছে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর শাসনের অনন্য মিশ্রণ। কিন্তু কয়জনই বা শিক্ষকের প্রতি সেই দীর্ঘস্থায়ী ভালোবাসা ধরে রাখতে পারে! হাইস্কুল জীবনের প্রিয় শিক্ষকের প্রখর স্নেহমাখা শাসন আজও হৃদয়ের ক্যানভাসে জ্বলজ্বল করছে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, বর্তমান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মনে।
ছাত্র থেকে শিক্ষক, শিক্ষক থেকে জীবনের কঠিন রাজপথে পথচলা—তারপর এমপি, মন্ত্রী এবং অবশেষে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন। জীবনে এত ব্যস্ততার মাঝেও প্রায় ছয় দশক পরে এসেও প্রিয় শিক্ষক মো. রুস্তম আলী খানকে ভুলতে পারেননি তিনি। সম্প্রতি শৈশবের বন্ধুদের এক মিলনমেলায় যোগ দিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিজ্ঞাপন
মির্জা ফখরুলের এই স্মৃতিচারণ যেন আবারও প্রমাণ করে, প্রকৃত শিক্ষক কেবল শাসন করেন না, বরং শাসনের আড়ালেও লুকিয়ে থাকে অফুরন্ত স্নেহ, ভালোবাসা আর মানবিকতার উষ্ণ ছোঁয়া।
বিজ্ঞাপন
১৯১৮ সালের ১ অক্টোবর পাবনা সদর জেলার দোগাছি ইউনিয়নের ব্রজনাথপুর গ্রামে জন্ম শিক্ষক মো. রুস্তম আলী খানের। ১৯৩৫ সালে এসএসসি, ১৯৩৭ সালে এইচএসসি ও ১৯৪১ সালে আরবি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও ইংরেজিতে বি.এ সম্মান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সফলতা অর্জন করেছিলেন। নবম-দশম শ্রেণিতে তিনি ইংরেজি পড়াতেন। প্রায় ২০ বছর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কিংবদন্তি এই প্রধান শিক্ষকের আমলেই স্কুলটি সরকারি করণ হয়। কর্মময় জীবনের বেশীর ভাগ সময়েই তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে কাটিয়েছেন।
শিক্ষকতা জীবনে অনেক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রুস্তম স্যার। সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আর্থিক কষ্টকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারেননি। তার চিন্তা ছিল শুধুই স্কুল ঘিরে। স্কুলের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ছাড়া ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে পরিকল্পনা ও উদ্যোগে সে সময়ে স্কুলটিতে একটি স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিলেন তিনি। কর্মজীবনে বিশেষ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে 'তমগায়ে খেদমত' উপাধি ভূষিত করেছিলেন।
প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতচারণ করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিদ প্রফেসর মনতোষ কুমার দে ঢাকা পোস্টকে বলেন, অত্যন্ত রাশভারী, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন রুস্তম আলী খান স্যার। তার ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ একসঙ্গে এই স্কুলে পড়তাম আমরা। আরেকজন আমাদের কৃতিছাত্র ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডক্টর সাইদুর রহমান। সেও পাবনা থেকে এসেছিল।
তিনি বলেন, রুস্তম আলী স্যার যদিও আরবিতে মাস্টার্স করেছিলেন কিন্তু তিনি ইংরেজিতে বেশ পারদর্শী ছিলেন এবং পুরো সাহিত্য স্যারের দখলে ছিল। তিনি যেমন শাসন করতেন আবার আদরও করতেন। আমরা ক্লাসে দুষ্টুমি করলে এগুলো আবার ক্লাস ক্যাপ্টেন বন্ধু আব্দুল গোফরান হেড স্যারের কাছে নালিশ করতো। এরপর বন্ধু মির্জা ফখরুল ও আমি ক্যাপ্টেন গোফরানের ব্যঙ্গচিত্র বোর্ডের মধ্যে আকতাম। ব্যঙ্গচিত্র করার পর ক্যাপ্টেন আমাদের নামে স্যারের কাছে নালিশ করে। স্যার আমাদের ডেকে পাঠান এবং বেত দিয়ে শাস্তি দেন। এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে।
মনতোষ কুমার দে বলেন, রুস্তম স্যার কিংবদন্তির মতো সবার কাছেই পরিচিত ছিলেন। তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলো করাতেন আমাদের দিয়ে। সেগুলো সব অসাধারণ ছিল। মুসা নামে একটি ঐতিহাসিক নাটক তিনি করেছিলেন, যাতে আমি অভিনয় করেছিলাম মুসা চরিত্রে আর বন্ধু মির্জা ফখরুল করেছিল মুসার ছেলের চরিত্রে। ছাত্রদের তিনি নাম ধরে ডাকতেন। এরকম একজন আদর্শবান প্রধান শিক্ষক আমরা এই স্কুলে পেয়েছিলাম। সৌহার্দ্য দিনগুলো মূলত তার দ্বারাই সূচিত হয়েছিল এবং তিনি এই স্কুলটাকে একটি শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এখান থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি চলে গিয়েছেন ঘোড়াশাল সার ফ্যাক্টরির এক প্রাইভেট স্কুলে। স্যারের মতো মানুষ পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের জীবনটা ধন্য হয়েছিল।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন লিজেন্ড ছিলেন রুস্তম আলী খান স্যার। একজন প্রধান শিক্ষকের কেমন হতে হয়, তার কাছ থেকে বর্তমান শিক্ষরা শিক্ষা নিতে পারেন। ঢাকা পোস্টকে অসংখ্য ধন্যবাদ তারা রুস্তম আলী খান সম্পর্কে প্রতিবেদন করছে। সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে।
রুস্তম আলী স্যারকে ষষ্ট থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র ও সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুল লতিফ। তিনি প্রিয় রুস্তম আলী স্যারের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
তিনি আরও বলেন, স্যারের এক ছেলে চিকিৎসক এবং স্যারের বাবা একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। উনি ঠাকুরগাঁওয়ে আসার পর একবার মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাড়ি যাওয়ার পথে পথ ভুলে অন্য এক গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। ছাত্ররা তখন তাকে খুঁজতে বেড়িয়ে ছিলাম। পরে দেখা যায় উনি একটি শস্যখেতের মাঝখানে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। এটা আমাদের জন্য খুবই মর্ম বেদনা। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই স্যার আস্তে আস্তে ভেঙে পড়তে শুরু করেন। শেষ জীবনে খুব অর্থকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। স্যারের মতো এমন পিতৃতুল্য স্নেহশীল শিক্ষকের সন্ধান পাওয়া ভার। প্রকৃতির অমোঘ বিধানে রুস্তম আলী খান স্যার ওপারে চলে গেলেও তার আদর্শ, সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীর মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ থেকে যুগান্তরে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ১৯৮৬ সালে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন রুস্তম আলী খান। পরে অপারেশন করে তার একটি পা কেটে ফেলেন চিকিৎসকরা।
রুস্তম আলী খানের ছাত্ররা যে তাকে কত ভালোবাসেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তখনই। ঠাকুরগাঁও থেকে তার প্রাক্তন ছাত্ররা মাইক্রোবাসে করে হাসপাতালে তাদের প্রিয় স্যারকে দেখতে গিয়েছিলেন, আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। অবসর গ্রহণের পর নাটোরে কোনোভাবে মাথা গোজাঁর ছোট্ট একটা বাড়ি করেছিলেন। চিকিৎসার জন্য আর্থিক সংকটে ভুগছিলেন তিনি। সেই দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে তার ছাত্ররা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার কয়েকদিন পরেই তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনি মনেপ্রাণে ঠাকুরগাঁওকে ভালোবাসতেন। এখানকার আলো, বাতাস ও মাটির সঙ্গে তিনি মিশে গিয়েছিলেন। তবে ঠাকুরগাঁওয়ে তার একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল করার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে তার সে আশা আর পূরণ হয়নি।
এএমকে