* মানুষের সেবায় গ্রামে ছড়িয়ে দেন স্কাউটিং

* গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

* শিক্ষকদের চিন্তা-কথা-কাজে নির্মল হতে হবে

আব্দুস সোবহান মিয়া। বয়স ৬৫ বছর ছুঁইছুঁই। কিন্তু দেখে তার বয়স বোঝার উপায় নেই। শারীরিক গঠন আর হাসিমাখা মুখে তাকে সবসময় দেখায় উৎফুল্ল। তারুণ্যের ছোঁয়া যেন এখনো তাকে ছুঁয়ে বেড়ায়। গ্রামের সবার কাছে এই বয়সেও তিনি একজন ‘মডেল’ শিক্ষক। প্রায় ২০ বছর আগে শিক্ষকতা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিলেও ছাড়েননি শিক্ষাঙ্গন। সেবামূলক কাজ আর নীতি-নৈতিকতার শিক্ষায় গ্রামের ছেলে-মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে গড়েছেন ব্যতিক্রম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘প্রভাতী মুক্ত স্কাউট ইনস্টিটিউট’। এখন তিনি শহর থেকে গ্রামে সবখানে ‘অনুপ্রেরণার স্যার’ হিসেবে পরিচিত।

রংপুর মহানগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আজিজুল্যাহ এলাকার আব্দুল জলিল মিয়া ও মোছা. ছোরতুন নেছা দম্পতির ছেলে আব্দুস সোহবান মিয়া। তিনি ১৯৭৬ সালে আফানউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৮ সালে কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর একই কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস কোর্স সম্পন্ন করে ১৯৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন রাজশাহী শারীরিক শিক্ষা কলেজে। সেখান থেকে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। 

দীর্ঘ ২২ বছরের শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে ১৯৮৪ সালে তিনি ফানউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে মাত্র ২৪ দিন শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। তিনি শারীরিক শিক্ষা ও স্কাউটিংসহ অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দিলেও নৈতিকতা ও সেবামূলক কাজের ব্যাপারে সবসময় উদ্বুদ্ধ করতেন।

স্কাউটিংয়ের জন্য আব্দুস সোবহান মিয়ার রয়েছে অন্যরকম পরিচিতি। তার পরিচালিত ‘প্রভাতী মুক্ত স্কাউট ইনস্টিটিউট’ও ব্যতিক্রম। এটি দেশের দ্বিতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে শতভাগ শিক্ষার্থীই স্কাউটস। আব্দুস সোবহান মিয়ার সহধর্মিনী শাহিদা বেগম এই ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষিক। আর তাদের দুই মেয়ে সাবাহ শাবনুম এবং সারাহ শবনমও স্কাউটিংয়ের সঙ্গে জড়িত। পুরো পরিবার স্কাউটসকে ধারণ করায় গ্রামের ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের কাছে তাদের রয়েছে গ্রহণযোগ্যতা।

১৯৯৯ সালে ছোট পরিসরে তিনি নিজ গ্রাম আজিজুল্যাহতে স্কাউটস স্কুল গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। তার নিজের এবং সহধর্মিনীর ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করেন। সেখানে ২০১১ সালে প্রভাতী মুক্ত স্কাউট ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এখন তার পরিচালিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩০০ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে।

মানুষের সেবায় গ্রামে ছড়িয়ে দেন স্কাউটিং

আব্দুস সোবহান মিয়া শিক্ষার্থীদের যেমন মানুষের জন্য, সমাজের জন্য ভালো কাজ করার পরামর্শ দিতেন। তিনি নিজেও তা করতেন। প্রতিদিন গ্রামের মেঠোপথ ধরে থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে পিচঢালা শহরে শিক্ষকতা করতে আসতেন তিনি। এ সময় তিনি ভাবতেন কিভাবে গ্রামের মানুষের সেবা করা যায়। কিভাবে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলোর সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও মানবিকতা সৃষ্টি করা যায়।

শিক্ষকতা, স্কাউটিং আর সেবার ব্রত তাকে গ্রামের মাটি ও মানুষের কাছে টেনে নিতো। তিনি গ্রামে একটা সেবামূলক প্রজেক্ট গড়েন। সেখানে রংপুর জেলা স্কাউটস ও বাংলাদেশ স্কাউটস সহযোগিতা করে। গ্রামে শিশুস্বাস্থ্য, সেনিটেশন এবং বনায়ন নিয়ে কাজ শুরু করেন। আব্দুস সোবহান মিয়ার গ্রামে স্কাউটিং তখনও খুব পরিচিত ছিল না। সেবামূলক কাজের কারণে দ্রুতই গ্রামে স্কাউটিং ছড়িয়ে পড়ে।

আব্দুস সোবহান মিয়ার সঙ্গে স্কাউটিংয়ে সম্পৃক্ত ছেলে-মেয়েদের সেবামূলক কাজ দেখে গ্রামের মানুষ আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধি দলের সদস্যরাও এসব কাজ দেখে প্রশংসা করেন। গ্রামের মানুষের পাশাপাশি ভিনদেশিদের কাছ থেকে কুড়ানো প্রশংসা ও অনুপ্রেরণাই আব্দুস সোবহান মিয়াকে শিক্ষকতার সঙ্গে স্কাউটিং করতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই থেকেই স্কাউটসকে ভালোবেসে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক।

কমছে নৈতিকতার শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থাতেও পার্থক্য

প্রভাতী মুক্ত স্কাউট ইনস্টিটিউটে কথা হয় আব্দুস সোবহান মিয়ার সঙ্গে। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি নব্বই দশকের শিক্ষকতা, পড়াশোনা, শিক্ষার্থী আর এখনকার সময়ের শিক্ষকতা এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে পার্থক্যের কথা জানান। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও স্মার্ট ফোনের সর্বাধিক ব্যবহার উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে নিলেও আমাদের দেশের প্রজন্মকে পিছিয়ে ফেলছে।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই শিক্ষকতা পেশায় এখন এসে আমার বারবার মনে পড়ছে, নব্বইয়ের আগের যে পড়ালেখা এবং এখনকার যে পড়ালেখা তার মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। যদিও আমরা স্মার্ট ও ডিজিটালাইজেশনের মধ্যদিয়ে উন্নত হচ্ছি। কিন্তু স্মার্ট ফোনটা বেশি সহজলভ্য হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলমুখী কম হচ্ছে। এতে করে তারা নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা থেকে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশের জন্য এই সমস্যাটা ওভারকাম করা কষ্টকর হবে।

সিলেবাসভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে আরও সমৃদ্ধ করে এমন কো-কারিকুলার প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামূলক করা দরকার বলে মনে করেন এই শিক্ষক। ঢাকা পোস্টকে আব্দুস সোবহান মিয়া বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েদের অনেক কিছু জানতে হয়, শেখার আছে। আমি সবসময় সেই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধারণ করতে উৎসাহ দেই। পড়ালেখার সঙ্গে স্কাউটিং করলে একজন শিক্ষার্থী হাতেকলমে রান্না, বৃক্ষরোপন, সেলাই, আবৃত্তি, শরীরচর্চাসহ অনেক কিছু শিখতে পারবে। এই শিক্ষাটা ব্যক্তিগত জীবনে কাজে লাগে। মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ও নৈতিক বিকাশে সহায়তা করে এবং তাদের সামগ্রিক শিক্ষাকে আরও উন্নত ও কার্যকর করে তোলে।

তিনি আরও বলেন, ছোটবেলা থেকে আমি স্কাউটিং পছন্দ করতাম। আমাকে ভালো লাগে আমার স্কাউটসের ছেলে-মেয়েরা অন্য আর দশটা ছেলে-মেয়ের চেয়ে ব্যতিক্রম। এই ছেলে-মেয়েরাই আমাদের সমাজকে উচ্চ শিখড়ে নিয়ে যাবে। আমরা যখন পড়ালেখা করতাম তখন আমাদের শিক্ষকরা একটা কথাই বলতেন, “শিক্ষার জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও”। এই কথাটা আমাকে সবসময় ভালো কাজে সাহস, শক্তি এবং অনুপ্রেরণা যোগাতো। আমি এ কথাটা ছেলে-মেয়েদের খুব বেশি বলে থাকি। শুধু পড়ালেখা করে কিংবা সার্টিফিকেট অর্জন করে ভালো মানুষ হওয়া যায় না। ভালো মানুষ হতে হলে মানুষের জন্য ভালো কাজ করতে হবে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভয় নেই, নৈতিকতার অবক্ষয় ছুঁয়েছে

আব্দুস সোবহান মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখনকার শিক্ষার্থীরা খুব আপডেট। অনেক গভীরে তারা প্রবেশ করতে চায় না। কোনো একটা প্রশ্ন করলে বা জানতে চাইলে তারা আগে মোবাইল ফোনে সার্চ দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে। নব্বইয়ের আগে এরকম স্মার্ট ফোন চর্চা ছিল না। তখনকার শিক্ষার্থীরা বই ঘেটে, পড়ালেখা করে জ্ঞান অর্জন করতো। তখন মাথা থেকে মুখে উত্তর বের হতো। আর এখন মোবাইল থেকে বের হয়। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় মনোযোগী হতে হবে।

তিনি মনে করেন, আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের মধ্যে ডিজিটাল নির্ভরতা থাকতে হবে। কিন্তু সেটাকে ধারণ করতে গিয়ে বই-খাতা-কলম এবং কো-কারিকুলার থেকে বিমুখ হলে কাঙ্খিত শিক্ষা অর্জন হবে না। এজন্য পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাঙ্গনের সবার কাছ থেকে মোটিভেশন আসতে হবে। সবাইকে একটা সুন্দর, সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতি গড়তে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। শুধু শিক্ষকের ওপর নির্ভর কিংবা শিক্ষকের ওপর দায় চাপালে হবে না।

আগে শিক্ষকতা ছিল মর্যাদার। এখন সেখানে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ছোঁয়া লাগায় পরিবর্তন এসেছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে শিক্ষকরা যেমন সম্মান পেতেন এখন আর তা নেই—যোগ করেন আব্দুস সোবহান মিয়া।

তিনি আরও বলেন, প্রকৃত শিক্ষকরা এখনো সম্মানিত। তাদের দেখলে এখনো অনেক শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে সম্মান করে আড়ালে চলে যায়। সাইকেল কিংবা অন্যবাহন থেকে নেমে পড়ে। হাঁটার সময় শিক্ষকের সম্মানে কখনো আগ বাড়িয়ে সামনে যায় না। মৃদু স্বরে কথা বলে। কিন্তু এসব এখন আগের মতো খুব বেশি চোখে পড়ে না। এটার অভাব এখন দেখা যাচ্ছে। কিছু শিক্ষকের মধ্যেও নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় আসার কারণে শিক্ষার্থীরাও এখন তাদেরকে সম্মান দেখানোর জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে।

আব্দুস সোবহান মিয়া বলেন, আমি শিক্ষকতায় এসেছিলাম দুটি কারণে একটি ছিল শিক্ষকতা মহান পেশা, অন্যটি সেবা ও সম্মান অর্জনের সুযোগ। আর এখন বেশির ভাগই এই পেশায় আসছে বেকারত্বের কারণে। এখন শিক্ষকদের সম্মানি সীমিত। তারা শিক্ষাবাণিজ্য অর্থাৎ টিউশন পড়ানোয় ঝুঁকছেন। পয়সার বিনিময়ে শিক্ষা দিচ্ছেন। আমাদের আগেরকার দিনের শিক্ষকরা এমন ছিলেন না। পাশাপাশি যখন একই পড়াশোনা করা অন্য পেশার আরেকজনের অর্থবৃত্ত দেখে তখন অনেক শিক্ষকের মধ্যে নৈতিকতার দুর্বলতা কাজ করে। এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে গিয়েও পড়ে। এই নৈতিকতার বিপর্যয় বেশি দিন স্থায়ী হতে দেওয়া যাবে না। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকতাকে বাঁচাতে হবে। শিক্ষার্থীদের শুধু নাগরিক নয় সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এটা করতে হবে।

শিক্ষকদের চিন্তা-কথা-কাজে নির্মল হতে হবে

স্কাউটসের সাত নম্বর আইনকে জীবনে সবসময় অনুসরণ করা প্রত্যেকের উচিত বলে মনে করেন আব্দুস সোবহান মিয়া। তিনি বলেন, শিক্ষকদের আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী হতে হবে, এটি স্কাউটসের এক নম্বর আইন। কিন্তু তিনি সবসময় সাত নম্বর আইনকে নিজের জীবনে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কারণ শুধু শিক্ষকই নয়, প্রত্যেকটি পেশার মানুষ যদি সত্যিকার অর্থে চিন্তা, কথা ও কাজে নির্মল হতে পারে তাহলে পুরো সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। আমরা সবাই মিলে একটা সুন্দর জাতি উপহার দিতে পারব।

তিনি আরও বলেন, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক আগে ছিল আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ। তখন শিক্ষকের শাসনে ব্যবহৃত বেত্রাঘাত ছিল ছাত্রকে পড়ালেখায় মনোযোগী করার প্রচেষ্টা। শিক্ষকরা অভিভাবকের ভূমিকায় ছাত্রদের প্রতি রাগ-অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতো। উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে একটা ছাত্রকে ভালো মানুষ করা যায়। ছাত্র-শিক্ষকের সেই সম্পর্ক এখনো বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু আগের মতো আন্তরিকতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই। এর কারণ এ পেশার শিক্ষকদের আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছি না। এখনো শিক্ষকের বেতন কোথাও ১২ হাজার, নয়তো ১৮ হাজার টাকা। অথচ শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষকের যথাযোগ্য মর্যাদা এবং মেধাবীদের এ পেশায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

আব্দুস সোবহান মিয়ার অর্জন

বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ১৯৮৯ সালে শ্রেষ্ঠ সংগঠক সম্মান অর্জন করেন তিনি। শিক্ষকতা পেশায় আসার কারণে ১৯৯৯ সালে শ্রেষ্ঠ স্কাউটস শিক্ষক পদক লাভ করেন নিভৃত গ্রাম থেকে উঠে আসা আব্দুস সোবহান মিয়া। ২০২৪ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ স্কাউটসের সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড রৌপ্য ব্যাঘ্র। অ্যাওয়ার্ডটি স্কাউটিংয়ের উন্নয়নে ধারাবাহিক ও নিরলস সেবা এবং অনন্য অবদানের জন্য তাকে প্রদান করা হয়।

তিনি রংপুর জেলা স্কাউটসের সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে তিনি সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করেন। বর্তমানে তিনি প্রভাতী মুক্ত স্কাউট ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রংপুরের গর্ব আব্দুস সোবহান মিয়া

আব্দুস সোবহান মিয়া ২২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে হাজারো শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করেছেন তার আদর-স্নেহ, নীতি-নৈতিকতা ও অনুপ্রেরণামূলক শিক্ষা দিয়ে। প্রতিদিন অন্তত একটি করে ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা এই শিক্ষকের শত শত শিক্ষার্থী এখন চিকিৎসক, শিক্ষক, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী। এখনো দূরদূরান্ত থেকে তার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা তাকে দেখতে আসেন, শুনতে আসেন তার প্রেরণার বাণী।   

স্থানীয় তরুণ সংগঠক হারুন অর রশিদ সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আব্দুস সোবহান মিয়া স্যার আজিজুল্যাহ, রঘুবাজার তথা পুরোনো তামপাট ইউনিয়নসহ পুরো রংপুরের গর্ব। তিনি একটি প্রত্যন্ত এলাকায় মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। স্কাউটিংয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রংপুর অঞ্চলকে দেশ এবং দেশের বাইরে আলাদাভাবে পরিচিত করেছে। তার অনুপ্রেরণায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এখন নিজেরাই সেবামূলক কর্মকাণ্ড করছে। তাকে অনুসরণ করা এবং তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে তার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্কাউটিংয়ে যুক্ত হয়েছিলেন মাহবুবুল হক রুশো। শিক্ষাজীবন শেষ করে তার এই ছাত্র এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে মাহবুবুল হক রুশো বলেন, আব্দুস সোবহান স্যার শুধু আমার শিক্ষক নন, তিনি আমার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থীর পথপ্রদর্শক ও অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে লড়াই করতে হয়। ধৈর্য, জ্ঞান ও ভালোবাসাকে পুঁজি করে কিভাবে মানবসেবা করা যায়। আমরা তাকে ‘নীতি-নৈতিকতার স্যার’ বলে ডাকতাম। তার কাছ থেকে অর্জিত শিক্ষা এখনো আমাকে ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আমি তার মতো শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরে গর্ববোধ করি।

শতবর্ষী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক ও রংপুর জেলা স্কাউটসের সাবেক কমিশনার সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের প্রিয় শিক্ষক আব্দুস সোবহান মিয়া শিক্ষকতা জীবনে একজন অনন্য বৈশিষ্টের অধিকারী। তিনি পাঠদানে, খেলাধুলা ও স্কাউটিংয়ের কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে অনুপ্রেরণা দিতেন যেন শিক্ষার্থীরা তার আপন সন্তান। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক কাজে নিজেও উপস্থিত থাকতেন। আব্দুস সোবহান স্যার সাধারণ শিক্ষার্থীসহ স্কাউটসদের কাছে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। তিনি ২০ বছর আগে অবসর নিলেও এখনো সবার কাছে সেরা। তার দক্ষতা, নৈতিকতায় দৃঢ়তা, শিক্ষায় সৃজনশীল ও মানবিক মুল্যবোধ শুধু শিক্ষার্থীদের নয় আমাদেরকে ভালো কিছু অনুপ্রেরণা যোগায়।

এএমকে