কাগজে কলমে তার পদবি অফিস সহকারী হলেও তিনি আসলে ছিলেন শিক্ষক। জীবনের টানা ২৭ বছর বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। তবে তার প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় অবসরে গিয়েও পাননি কোনো সুবিধা। তাই জীবনের তাগিদে এখন রাত জেগে বাজার পাহারা দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। 

তিনি হলেন পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার টোকরাভাষা ইসলামিয়া একরামিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার পরিচিত মুখ মো. তোহিদুল ইসলাম (৭৩)। যাকে সবাই চেনে ‘সোনা মাস্টার’ নামে।

তোহিদুল ইসলাম দেবীগঞ্জ উপজেলার চিলাহাটি ইউনিয়নের টোকরাভাষা এলাকার মৃত তসির উদ্দীনের ছেলে। ১৯৮৭ সালে তিনি মাদরাসার ইবতেদায়ী শাখায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটি দাখিল শাখার অনুমতি পেলে তিনি অফিস সহকারী পদে যোগ দেন। তবে প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি নিয়মিত ক্লাসও নিতেন তিনি। ২০১৪ ‍সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।

কিন্তু মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় কোনো বেতন পাননি টানা ২৭ বছর। ২০১৪ সালে অবসরে যেতে হয় তাকে। তবুও পাননি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা। বর্তমানে তিনি স্থানীয় টোকরাভাষা বাজারে নাইটগার্ড হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিদিনের আয় মাত্র ১৫০ টাকা। যা দিয়ে কোনোমতে চলে সংসার।

তোহিদুল ইসলাম বলেন, জীবনের সোনালি সময়টা মাদরাসার জন্য দিয়েছি। কোনো বেতন পাইনি, অবসরে গিয়েও কিছু পেলাম না। এখন রাত জেগে বাজার পাহারা দিয়ে সংসার চালাই।

মাদরাসা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে টোকরাভাষা ইসলামিয়া একরামিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার যাত্রা শুরু হয় ইবতেদায়ী শাখা দিয়ে। বর্তমানে প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে সেখানে। প্রতিবছর ১৫–২০ জন শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয়। শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ১৮ জন। তাদের সবার জীবনই অনিশ্চয়তায় ঘেরা।

বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সোনা মাস্টার ছিলেন তাদের প্রিয় শিক্ষক।

৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুন বলেন, স্যার অবসরে যাওয়া পরেও এখনও মাদরাসায় এসে ক্লাস নেন। আমাদের খুব যত্ন সহকারে পড়ান। তিনি শুধু শিক্ষক নন, অভিভাবকের মতো।

সাবেক শিক্ষার্থী আয়শা সিদ্দীকা বলেন, আমাদের এলাকায় যারা একটু ভালো জায়গায় গেছে, সবার পেছনে সোনা স্যারের হাত আছে। অথচ আজ তিনি নাইটগার্ডের কাজ করছেন এটা আমাদের জন্য কষ্টের ও লজ্জার।

স্থানীয় অভিভাবক আনছারুল বলেন, এত বছর বিনা বেতনে একজন মানুষ কীভাবে শিক্ষাদান চালিয়ে গেলেন, সেটাই বিস্ময়ের বিষয়। সরকার যদি দ্রুত এই মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত না করে, তাহলে শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবনযাপন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়বে।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মোশাররফ হোসেন বলেন, সোনা মাস্টার শুধু শিক্ষক নন, তিনি এলাকার একজন আদর্শ মানুষ। বর্তমানে তিনি বাজারে নাইটগার্ড হিসেবে কাজ করছেন। তার প্রাপ্য সম্মান ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা তিনি কোনোদিন পাননি এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

টোকরাভাষা বাজার বণিক সমিতির সভাপতি কামাল মোস্তাহারুল হাসান নয়ন বলেন, সোনা মাস্টার আমাদের বাজারের নাইটগার্ড হিসেবে কাজ করেন। বয়স হলেও তিনি খুব দায়িত্বশীল মানুষ। আমরা বণিক সমিতির পক্ষ থেকে তার পাশে থাকার চেষ্টা করছি। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন যদি এমন মানুষের প্রতি একটু নজর দেয়, তাহলে সমাজ উপকৃত হবে।

মাদরাসাটির ভারপ্রাপ্ত সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে আমরা সরকারের কাছে আবেদন করে আসছি, কিন্তু এখনও আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।

দেবীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) সাইফুল ইসলাম বলেন, টোকরাভাষা ইসলামিয়া একরামিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসাটি দীর্ঘদিন ধরে এমপিওবহির্ভূত। সোনা মাস্টার বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন এটা সত্যিই প্রশংসনীয়।

আরকে