আজ ৯ অক্টোবর, বিশ্ব ডাক দিবস। এক সময় প্রিয়জনের খোঁজ নেওয়ার একমাত্র ভরসা ছিল ডাক বিভাগ। চিঠির খামে লেখা থাকত আবেগ, ভালোবাসা ও অপেক্ষার গল্প। থাকত প্রিয়জনের স্পর্শ।

‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’- কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর এই গানের বোল যেন আজ শুধুই নস্টালজিয়ার গল্প। কবি হয়তো কল্পনাও করেননি, একদিন মানুষ সত্যিই শুধু ‘আকাশের ঠিকানায়’- চিঠি লিখবে! থাকবে না খাম, থাকবে না হাতের লেখার মাধুর্য, থাকবে না মনের গভীরতার ছোঁয়া। থাকবে শুধু ই-মেইল আর মেসেঞ্জার।

এক সময় চিঠি ছিল ভালোবাসার, আবেগের, খবরের একমাত্র বাহন। আজ সেটি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হাতে লেখা চিঠির দিনগুলো হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ডাকবাক্সের কোলাহল, ডাক হর করার অপেক্ষা।

আগে গ্রাম-শহর সর্বত্র লাল রঙের ডাকবাক্সে প্রতিদিনই চিঠির স্তূপ জমত। এখন সেই ডাকবাক্সগুলো পড়ে আছে ধুলায় ঢাকা, মরিচা পড়া নিঃসঙ্গ স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। 

উপজেলা পোস্ট অফিস সূত্রে জানা গেছে, আগে প্রতিদিন অসংখ্য ব্যক্তিগত চিঠি আসত, এখন বেশিরভাগই অফিসিয়াল নথিপত্র, আবেদনপত্র বা বিবাহ-তালাক সংক্রান্ত চিঠি।

শালিখা উপজেলা পোস্টমাস্টার মহিতোষ কুমার মণ্ডল বলেন, আগে ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের পরিমাণ ছিল অনেক। এখন অফিসিয়াল নথি বা বিবাহ রেজিস্টার, তালাক সংক্রান্ত কাগজপত্রই বেশি আসে। তবুও মাঝে মাঝে কারও ব্যক্তিগত চিঠি এলে আলাদা ভালো লাগা কাজ করে।

অথচ মাত্র কয়েক দশক আগেও প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল চিঠি। কেউ কেউ আবার পোষা পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে পাঠাতেন। মুখে বলতে না পারা কথাগুলোও মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা হতো কাগজে। একেকটি চিঠি হয়ে উঠত একেকটি ইতিহাস, একেকটি অনুভূতির দোলাচল।

এখন ই-মেইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ- সবই যোগাযোগের হাতিয়ার। কিন্তু এই সহজলভ্যতার আড়ালে হারিয়ে গেছে সেই ‘অপেক্ষা’র সৌন্দর্য, হারিয়ে গেছে হাতের লেখায় ভরা আবেগের উষ্ণতা। এখন ভালোবাসা প্রকাশ পায় ইমোজিতে, অশ্রু বা হাসি প্রকাশ পায় স্ক্রিনে।

শ্রীপুরের বাসিন্দা শাহ নেওয়াজ বলেন, “এক সময় প্রিয়জনের খোঁজখবর নিতে আমরা চিঠি আদান-প্রদান করতাম। কিন্তু এখন মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের কারণে সেই চিঠির দিন শেষ হয়ে গেছে। চিঠি এখন শুধুই স্মৃতি।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা আকিদুজ্জামান মনে করেন, চিঠি ছিল আবেগের এক অপার উৎস। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ রাইফেলসে (বিডিআর) চাকরি করার সময় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল চিঠি। চিঠি পেলে মনে হতো পৃথিবী জুড়ে আনন্দ। এখন সেই অপেক্ষার দিন আর নেই। তথ্য প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে গেছে।

চিঠি দিবস উদযাপনের প্রচলন হয় ২০১৪ সালে। অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রিচার্ড সিম্পকিন প্রিয়জনদের কাছে চিঠি পাঠাতেন এবং চিঠির উত্তর পেলে ভীষণ আনন্দিত হতেন। তার অনুপ্রেরণায় শুরু হয় এই দিবস পালনের ধারা, যার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে আবার চিঠি লেখায় ফিরিয়ে আনা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে- প্রযুক্তির এই ঝড়ে সেই চর্চা ফিরে আসা এখন প্রায় অসম্ভব।

চিঠির সাথে হারিয়ে যাচ্ছে এক নীরব মানবিক সংস্কৃতি। কাগজে কলমে মনের কথা জানানোর সে দিনগুলো এখন স্মৃতির পাতায় বন্দি।

আজও কিছু ভগ্ন ডাকবাক্স গ্রামের কোণায়, স্কুলের দেয়ালে বা পোস্ট অফিসের সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে- যেন তারা অপেক্ষা করছে এক টুকরো কাগজের, যেটিতে লেখা থাকবে মনের কথা, ভালোবাসার বার্তা, কিংবা শুধু দুটি শব্দ ‘ভালো থেকো।’

শ্রীপুর উপজেলার কাজলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মোল্লা মতিয়ার রহমান বলেন, বিশ্ব ডাক দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষে মানুষে সম্পর্কের সেতু গড়ে তুলেছিল ডাকব্যবস্থা। সেটি কেবল ইতিহাস নয়, আমাদের সংস্কৃতিরও অংশ। এক সময় চিঠি ছিল ভালোবাসার, বন্ধুত্বের, সম্পর্কের সবচেয়ে উষ্ণ বাহন। আজ প্রযুক্তির এই দ্রুত যুগে চিঠির সেই মাধুর্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও ডাকের ইতিহাস আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আজ প্রযুক্তির যুগে ডাকের সেই ভূমিকা বদলে গেলেও ডাকসেবা এখনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আরকে